বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক অনন্য দিন। এক ঐতিহাসিক সকাল। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখনো বসেনি পুরো দর্শক, কিন্তু টিভির সামনে অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি। কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে স্থিতিশীল, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ হিসেবে পরিচিত মুশফিকুর রহিম দাঁড়িয়ে ছিলেন এক অনন্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে।
গতকাল তিনি ৯৯ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছিলেন। আজ মাঠে ফেরার পর তার দরকার ছিল স্রেফ একটি রান—যা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল।
এবং সেটাই হলো। ৩য় বলটিকে স্কয়ার লেগে ঠেলেই তিনি স্পর্শ করেন কাঙ্ক্ষিত তিন অঙ্কের ম্যাজিক নাম্বার। দুই হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে জানালেন কৃতজ্ঞতা। আর ক্রিকেটবিশ্ব জানল—শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করা সৌভাগ্যবান ক্রিকেটারদের তালিকায় যুক্ত হলো নতুন একটি নাম: মুশফিকুর রহিম।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এর আগে কেউ এই মাইলফলকের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেননি। ২০০৫ সালে অভিষেকের পর দীর্ঘ দুই যুগের পথচলায় যিনি বারবার দলকে বাঁচিয়েছেন, সেই মুশফিকই আজ ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম সোনালি অক্ষরে লিখে দিলেন।
ইতিহাসের পাতায় মুশফিক: বিশ্বের মাত্র ১১ জন ক্রিকেটারের ক্লাবে জায়গা
বিশ্ব ক্রিকেটে শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করার কীর্তিটা মোটেও সহজ নয়। কারণ শততম টেস্টে পৌঁছানোই বিশাল অর্জন—তারপর আবার এমন ম্যাচে সেঞ্চুরি? এটি সত্যিই কিংবদন্তিদের কাজ।
এই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১১ জন।
যাদের মধ্যে আছেন—
- গর্ডন গ্রিনিজ
- জাভেদ মিঁয়াদাদ
- ইনজামাম-উল-হক
- গ্রায়েম স্মিথ
- রামনরেশ সারওয়ান
- রিকি পন্টিং (দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি!)
- হাশিম আমলা
- জো রুট (ডাবল সেঞ্চুরি)
- ডেভিড ওয়ার্নার (ডাবল সেঞ্চুরি)
এবার তাদের কাতারে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম।
এটি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বিশাল গর্বও বটে।
সকালের নাটকীয়তা: লিটনের এক রানেই ইতিহাস
সকালে ম্যাথু হাম্প্রিসের প্রথম ওভারটি সতর্কভাবে খেলেন মুশফিক। সেখানেই বোঝা যাচ্ছিল—আজ তিনি কোনভাবেই ভুল করতে চান না।
পরের ওভারে স্ট্রাইকে আসেন লিটন দাস। জর্ডান নিলের করা প্রথম বলেই তিনি এক রান নিয়ে স্ট্রাইক তুলে দেন মুশফিকের হাতে। আর তার ঠিক দুটি বল পরেই এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত রানটি।
স্টেডিয়ামজুড়ে হাততালি, সতীর্থদের উল্লাস, টিভি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ—সব মিলিয়ে মিরপুর তখন উৎসবের শহরে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডও ছুঁলেন মুশফিক
সেঞ্চুরি করার মাধ্যমে তিনি আরেকটি রেকর্ডে পৌঁছে গেলেন।
বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ইতিহাসে এখন—
সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি (১৩) : মুমিনুল হক ও মুশফিকুর রহিম (যৌথভাবে)।
মুশফিকের এই ইনিংসের পর তার ব্যাটিং গড়, রান, অভিজ্ঞতা—সবই বলে দিচ্ছে কেন তাকে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিদায়েও প্রশংসা: ২১৪ বলে ১০৬ রানের মাস্টারপিস
দীর্ঘ অপেক্ষার পর সেঞ্চুরি পেলেও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি তিনি। ম্যাথু হাম্প্রিসের হালকা বাউন্সে তিনি ক্যাচ দেন অ্যান্ডি বালবার্নির হাতে।
তবে তার আগে ২১৪ বল মোকাবিলা করে করেছিলেন ১০৬ রান—যেখানে ছিল ৫টি চার। টেস্ট ম্যাচের ধৈর্যের পাঠ বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেটিই খেলেছেন তিনি।
তার বিদায়ের ফলে ভাঙে লিটনের সঙ্গে গড়া ১০৮ রানের জুটি।
লিটন দাসও পায়ের ছাপ রাখলেন
মুশফিকের সেঞ্চুরির পরই লিটন দাস চার মেরে নিজের ২০তম টেস্ট হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করেন।
বাংলাদেশের টেস্ট দলের ব্যাটিংভাগের অন্যতম স্তম্ভ তিনি।
এ মুহূর্তে তার সঙ্গে ক্রিজে আছেন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ।
এর আগে গতকাল স্বাগতিক বাংলাদেশ ৪ উইকেটে ২৯২ রানে দিন শেষ করেছিল।
টেস্টের প্রেক্ষাপট: কেন এই সেঞ্চুরি এত গুরুত্বপূর্ণ?
১) শততম টেস্টে খেলা—অর্জন নিজেই বিরল
বাংলাদেশের মাত্র দুইজন ক্রিকেটার এত টেস্ট খেলতে পেরেছেন—
১. মুশফিক
২. তামিম (যদিও তিনি শততম টেস্টের আগেই অবসর নেন)
শততম টেস্টই যেখানে বিশাল ব্যাপার, সেখানে সেঞ্চুরি তো আরও অসাধারণ।
২) দীর্ঘ ২০ বছরের ক্যারিয়ার
২০০৫–২০২৫—দুই দশক লম্বা ক্যারিয়ার।
মুশফিকের মতো পরিশ্রমী ক্রিকেটার বাংলাদেশে খুব কমই এসেছে।
ফিটনেস নিয়ে তার শৃঙ্খলা এখনো তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য রোল মডেল।
৩) দেশের জন্য বারবার সামনে থেকে লড়াই
- গোলোনে সেঞ্চুরি
- ভারতের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে মহাকাব্যিক ইনিংস
- শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর (২০০+)
- এবং অসংখ্য ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস
এগুলোই তাকে বিশেষ করে তোলে।
গ্রিনিজ-মিঁয়াদাদদের কাতারে দাঁড়ানোর মাহাত্ম্য
গর্ডন গ্রিনিজ বা জাভেদ মিঁয়াদাদ—এরা কেবল নাম নয়, ক্রিকেটের কিংবদন্তি।
তাদের পাশে নিজের নাম দেখতে পাওয়া কোনো সাধারণ অর্জন নয়।
শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারদের তালিকা বিশ্ব ক্রিকেটের অভিজাত ক্লাব—এক ধরনের হালের ব্যাজ।
এটি বোঝায়—
- দীর্ঘসময় ধরে পারফর্ম করা
- দেশের সেরা ব্যাটার হওয়া
- মানসিকভাবে শক্ত
- চাপ সামলে দক্ষতা বজায় রাখা
এগুলোর সবই প্রমাণ করেছেন মুশফিক।
মুশফিকের সেঞ্চুরির প্রভাব: দলীয় মনোবল বাড়ল কয়েকগুণ
১) ড্রেসিং রুমে ইতিবাচক পরিবেশ
টেস্টের প্রথম দিনেই বড় রান পাওয়ায় ব্যাটিং ইউনিট আরও আত্মবিশ্বাসী।
২) লিটন-মিরাজের ওপর চাপ কমে গেল
সংগ্রহ ইতোমধ্যেই বড়, এখন লক্ষ্য ৪০০–৪৫০ রানের দিকেই।
৩) বোলারদের জন্য বাড়তি সুবিধা
বড় স্কোর হলে বোলাররাও স্বাচ্ছন্দ্যে আক্রমণাত্মক হতে পারবেন।
কেন মুশফিককে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা টেস্ট ব্যাটার বলা হয়
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার তিনজন—
১. মুশফিকুর রহিম
২. মুমিনুল হক
৩. সাকিব আল হাসান (অলরাউন্ডার হলেও ব্যাটিংয়ে অসাধারণ)
তাদের মধ্যে ধারাবাহিকতা ও বড় মাইলফলকগুলোর দিক দিয়ে মুশফিক এগিয়ে।
- সর্বোচ্চ শতক
- গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মেরুদণ্ডের মতো থাকা
- বিদেশে ভালো খেলা
- উইকেটকিপার হিসেবেও ইতিহাস গড়া
সব মিলিয়ে তিনি সেরা টেস্ট ব্যাটার হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে এই ইনিংস কোথায় দাঁড়ায়
সময়ের বিচারে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। কারণ—
- এটি একটি মাইলফলক ম্যাচ
- সেঞ্চুরিটি এসেছে দায়িত্বশীলভাবে
- দলকে বড় সংগ্রহ এনে দিয়েছে
- নতুনদের জন্য উদাহরণ তৈরি করেছে
সমালোচনার মুখেও তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন—
“আমি এখনো বাংলাদেশের সেরা ব্যাটারদের একজন।”
মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য নায়ক।
এর আগে তিনি দেশের জন্য অনেক রেকর্ড গড়েছেন।
কিন্তু শততম টেস্টে সেঞ্চুরি—এটি তাকে বিশ্ব ক্রিকেটের প্রধান মঞ্চে আরেকবার প্রতিষ্ঠিত করল।
এই মাইলফলক শুধু মুশফিকের নয়, এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই দিনটি দীর্ঘদিন মনে রাখবে সমর্থকরা।
কারণ এই দিনে এক বাঙালি ক্রিকেটার নিজের নাম খোদাই করেছেন—
গ্রিনিজ, মিঁয়াদাদ, পন্টিং, রুটদের পাশেই।
MAH – 13890 I Signalbd.com



