আঞ্চলিক

এনজিও গ্রাহকদের ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, মূলহোতা গ্রেফতার

Advertisement

অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এনজিও গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎকারী একটি বিশাল প্রতারক চক্রের মূলহোতা মো. নাজিম উদ্দিন তনুকে (৩৭) গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বুধবার (১৯ নভেম্বর) সকালে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নওগাঁ সদরের অফিসপাড়া এলাকায় ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি ভুয়া এনজিওর পরিচালক ছিলেন এই নাজিম উদ্দিন তনু। তার এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন ৮০০’রও অধিক দরিদ্র বিনিয়োগকারী।

গ্রেফতারের বিস্তারিত তথ্য ও সিআইডি’র বক্তব্য

দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকার পর অবশেষে প্রতারক চক্রের মূলহোতাকে ধরতে সক্ষম হয়েছে সিআইডি

গ্রেফতারের স্থান ও তারিখ: বুধবার (১৯ নভেম্বর) সকালে ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে মো. নাজিম উদ্দিন তনুকে গ্রেফতার করা হয়। সে নওগাঁ সদর এলাকার বাসিন্দা।

সিআইডি’র নিশ্চিতকরণ: সিআইডির মিডিয়া বিভাগ থেকে এই গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান সাংবাদিকদের কাছে এই সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

প্রতারিত অর্থের পরিমাণ: প্রাথমিক তদন্তে সিআইডি জানতে পেরেছে যে, ৮০০’র অধিক ভুক্তভোগী গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

প্রতারণার পদ্ধতি: অতিরিক্ত মুনাফার লোভ

নাজিম উদ্দিন তনু এবং তার পরিচালিত ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ একটি সুকৌশলী পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে তাদের অর্থ আত্মসাৎ করে।

আকর্ষণের মূলনীতি: এই এনজিওটি সাধারণ মানুষকে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে ২ হাজার টাকা হারে উচ্চ লভ্যাংশ প্রদানের লোভ দেখায়। এই লভ্যাংশের হার ছিল প্রচলিত ব্যাংকিং বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি।

প্রাথমিক কৌশল: প্রতারকরা প্রথম দিকে নিজেদের মনোনীত কিছু গ্রাহককে নিয়মিত এই হারে লভ্যাংশ প্রদান করে বিশ্বাস অর্জন করে।

ব্যাপক প্রচার: এরপর পরিচালকরা সুকৌশলে এই উচ্চ লভ্যাংশের বিষয়টি প্রচার করা শুরু করলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী, ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’-এ গ্রাহক হিসেবে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। সঞ্চয় জমা দান, মাসিক ডিপিএস, এককালীন আমানত এবং ঋণ গ্রহণের জন্য অনেকেই নিবন্ধন করেন।

ভুক্তভোগীদের করুণ চিত্র

প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকদের বেশিরভাগই ছিলেন সমাজের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ, যারা অধিক লাভের আশায় কষ্টের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছিলেন।

মামলার এজাহার: নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী অভিযোগ করেন যে, তিনিসহ আরও অনেক সদস্য এই প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় জমা, মাসিক ডিপিএস এবং এককালীন আমানত হিসেবে অর্থ জমা করেন।

ক্ষতির পরিসংখ্যান: বাদীর আমানত হিসেবে মোট ২০ লাখ টাকা জমা ছিল। এছাড়াও এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ভুক্তভোগীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল। পরে সিআইডি জানায়, মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

আমানতের উৎস: প্রতারিত হওয়া অর্থগুলো বেশিরভাগই ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সারাজীবনের সঞ্চয়, অবসর গ্রহণের অর্থ বা জরুরি প্রয়োজনের জন্য জমানো টাকা। এই প্রতারণা বহু পরিবারকে পথে বসিয়েছে।

প্রতারণা উন্মোচন ও টালবাহানা

২০২৪ সালের আগস্ট পরবর্তী সময়ে যখন প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা দেখা দেয়, তখনই গ্রাহকরা প্রতারণার বিষয়টি টের পান।

অস্বচ্ছতা: ভুক্তভোগী গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত বা ঋণের অর্থ ঠিকঠাক উত্তোলন করতে পারছিলেন না।

সময়ক্ষেপণ: বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানালে পরিচালক তনু গ্রাহকদের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।

জোরপূর্বক বহিষ্কার: কিন্তু গত বছরের নভেম্বর মাসে পুনরায় ভুক্তভোগীরা ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ অফিসে উপস্থিত হয়ে নিজেদের অর্থ ফেরত চাইলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে, গ্রাহকদের কোনো প্রকার অর্থ দেওয়া হবে না মর্মে জানিয়ে তাদেরকে অফিস থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পরই বাদী নওগাঁ সদর থানায় মামলা করেন।

তদন্তের গতি প্রকৃতি ও অন্যান্য জড়িত

মামলাটি বর্তমানে সিআইডির নওগাঁ জেলা ইউনিট পরিচালনা করছে। সিআইডি এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদেরও চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তদন্তের দায়িত্ব: মামলাটি সিআইডির অধীনে আসার পর তদন্ত দ্রুত গতি পায় এবং অবশেষে মূলহোতাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়।

চক্রের অন্যান্য সদস্য: সিআইডি আরও জানিয়েছে, এই মামলার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় মো. নাজিম উদ্দিন তনু ছাড়াও এই চক্রের আরও একাধিক সদস্যকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা: সিআইডি এখন নাজিম উদ্দিন তনুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আত্মসাৎ করা অর্থের অবস্থান জানার চেষ্টা করবে। জনগণের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করাই এখন সিআইডি’র প্রধান লক্ষ্য।

এনজিও প্রতারণার প্রবণতা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’-এর মতো এনজিও বা কো-অপারেটিভের নামে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করার প্রবণতা বাংলাদেশে একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা।

নিয়ন্ত্রণের অভাব: অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির অভাবে এই ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত গড়ে ওঠে এবং নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করে।

দ্রুত ধনী হওয়ার লোভ: সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত ধনী হওয়ার বা অতিরিক্ত লাভের আশায় বিনিয়োগ করার প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে এই চক্রগুলো সুযোগ নেয়।

আইনের প্রয়োগ: এই ধরনের প্রতারকদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ একই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।

ভুক্তভোগীর আমানতের তথ্য

“বাদীর আমানত হিসেবে মোট ২০ লাখ টাকা ছিল। এছাড়াও ভুক্তভোগীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, মোট প্রায় ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।” — সিআইডি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য

৬০০ কোটি টাকার বিশাল এই প্রতারণার মূলহোতা মো. নাজিম উদ্দিন তনুর গ্রেফতার দরিদ্র ও প্রতারিত গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। এটি একটি গুরুতর অর্থনৈতিক অপরাধ, যেখানে ৮০০’রও বেশি মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। সিআইডিকে এখন দ্রুত এবং কার্যকরভাবে আত্মসাৎ করা অর্থের পুনরুদ্ধার এবং এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি, সরকারের উচিত এনজিও এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করা, যাতে ভবিষ্যতে নিরীহ মানুষরা এমন প্রতারণার শিকার না হন।

এম আর এম – ২৩১৩,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button