তিস্তা নদীর পানি, লালমনিরহাট বন্যা, বাংলাদেশ বন্যা খবর, হাতীবান্ধা বন্যা, কালীগঞ্জ বন্যা, আদিতমারী বন্যা, নীলফামারী বন্যা, গাইবান্ধা বন্যা, কুড়িগ্রাম বন্যা, উজানের ঢল, ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্ট, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সোলার প্যানেল নদী প্রবাহ, কৃষি জমি ক্ষতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, ত্রাণ সহায়তা, বন্যা সতর্কতা কেন্দ্র, ধরলা নদী, চরাঞ্চল প্লাবন, বাংলাদেশ বর্ষাকাল, উত্তরবঙ্গ বন্যা পরিস্থিতি, গ্রামীণ রাস্তা প্লাবিত, মাছ ভেসে যাওয়া, বাঁধ রক্ষা অভিযান
সংবাদ প্রতিবেদন (পুনর্লিখিত ও বিস্তৃত)
উজানের ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টির কারণে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে, ফলে জেলার নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। গত দুই দিন ধরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) সকাল ৬টায় ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির স্তর বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপরে রেকর্ড করা হয়।
এই পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার ২০টির বেশি গ্রামের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার পরিবার বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
প্লাবনে গ্রামীণ জীবন বিপর্যস্ত
পানি ঢুকে পড়েছে বহু বসতবাড়ি, রোপা আমন ক্ষেত এবং অন্যান্য মৌসুমি ফসলের জমিতে। ভেসে গেছে বহু পুকুরের মাছ, যা স্থানীয় মৎস্যচাষিদের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে এনেছে। অনেক গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে দুর্গত মানুষরা বাজার, হাসপাতাল কিংবা অন্যান্য জরুরি স্থানে যাতায়াত করতে পারছেন না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটি ইতোমধ্যেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো গৃহপালিত পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধ, উঁচু রাস্তা কিংবা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পদক্ষেপ
তিস্তার প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, আগামী দুই দিন এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকতে পারে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার রায় বলেন,
“উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকতে পারে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলিকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছি।”
বন্যা সতর্কতা কেন্দ্রের তথ্য
বন্যা সতর্কতা কেন্দ্রের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
- কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।
- ধরলা নদীর শিমুলবাড়ি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে তিস্তার পানির মাত্রা দ্রুত ওঠানামা করায় সতর্ক থাকা জরুরি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
প্লাবিত এলাকা
প্লাবিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- পাটগ্রাম উপজেলায়: গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী।
- কালীগঞ্জ উপজেলায়: ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী।
- আদিতমারী উপজেলায়: মহিষখোচা, গোবর্ধন, কালমাটি, বাহাদুরপাড়া, পলাশী।
- সদর উপজেলায়: ফলিমারী, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী, গোকুন্ডা।
এই সব এলাকায় কৃষিজমি, বসতবাড়ি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ ও সোলার প্যানেলের প্রভাব
দক্ষিণ ভোটমারী এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম বলেন,
“নদীতে সোলার প্যানেল বসানোর কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ পরিবর্তিত হয়েছে। এতে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে বাঁধ ও রাস্তার ওপর চাপ তৈরি করছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বসতভিটা ও কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হবে।”
স্থানীয়দের দাবি, নদীর প্রবাহে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টির ফলে শুধু পানি নয়, বালু ও পলি জমা হচ্ছে লোকালয়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি ও বসবাসের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
কৃষিতে ক্ষতি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
রোপা আমন ধান বর্তমানে বৃদ্ধির পর্যায়ে রয়েছে। পানির দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান ধানের চারা পচে যাওয়া, শিকড়ে অক্সিজেনের ঘাটতি এবং রোগবালাই বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করছে। একই সঙ্গে শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণও অনেক। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে চাষের মাছ, যা পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ সময় লাগবে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ত্রাণ কার্যক্রম ও প্রশাসনের প্রস্তুতি
জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন,
“ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা প্রস্তুতের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা সম্পন্ন হলেই দ্রুত ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।”
প্রশাসন জানিয়েছে, ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পাঠানো হয়েছে। তবে দুর্গত এলাকার বিস্তৃত অবস্থার কারণে সব পরিবারে সহায়তা পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগছে।
উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলার পরিস্থিতি
নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী, চিলমারী ও উলিপুর এলাকায়ও তিস্তার পানি বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তার সঙ্গে মিলিত প্লাবন পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্যা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ পানি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং উজানে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আকস্মিক ঢল। তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য—
- নদী খনন ও প্রবাহ সচল রাখা
- বাঁধ শক্তিশালীকরণ
- সোলার প্যানেলের মতো কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা অপসারণ
- দ্রুত সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ
এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিস্তার পানি বৃদ্ধি শুধু লালমনিরহাট নয়, উত্তরবঙ্গের আরও কয়েকটি জেলার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণও যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই সংকট মোকাবিলা করতে।
MAH – 12304 , Signalbd.com



