আঞ্চলিক

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নকে ঘিরে সড়ক অবরোধ-মশাল মিছিল

Advertisement

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীরা তীব্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। দলীয় মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সদস্য আলহাজ্ব কবির আহমেদ ভূঁইয়াকে প্রার্থী করার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চলছে এই আসনে। বুধবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আখাউড়া উপজেলায় কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে হাজারো নেতাকর্মী মশাল মিছিল বের করে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তাদের এই কর্মসূচি প্রমাণ করে যে, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে বড় ধরনের বিভেদ তৈরি হয়েছে।

বিক্ষোভের মূল কারণ: কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য মুশফিকুর রহমানকে। এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা এবং তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী আলহাজ্ব কবির আহমেদ ভূঁইয়াকে বঞ্চিত করে মুশফিকুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই এই আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, কবির আহমেদ ভূঁইয়া এলাকায় দলের দুর্দিনে সক্রিয় ছিলেন এবং তার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় রাজনীতিতে কবির আহমেদ ভূঁইয়ার সমর্থকদের চরম হতাশ করেছে, যার ফলশ্রুতিতে তারা কঠোর আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন।

প্রতিবাদের ধরন: মশাল মিছিল ও কাফনের কাপড়

বুধবার সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রতিবাদকে আরও জোরালো এবং প্রতীকী করে তোলার জন্য এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন।

  • মশাল মিছিল: সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৌর শহরের বাইপাসের নারায়নপুর এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা হাতে মশাল নিয়ে মিছিল বের করেন। মশালের আলোয় স্লোগান দিতে দিতে তারা আখাউড়া-আগরতলা সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।
  • সড়ক অবরোধ: মিছিলটি নারায়নপুর চত্বরের ‘আই লাভ আখাউড়া’ মঞ্চের কাছে এসে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশে রূপ নেয়। এই অবরোধের ফলে গুরুত্বপূর্ণ আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, যা জনজীবনে কিছুটা দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
  • কাফনের কাপড়: বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শত শত নেতাকর্মী কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়েছিলেন। কাফনের কাপড় পরা ছিল তাদের প্রতিবাদের এক শক্তিশালী প্রতীকী ভাষা—যা বোঝায় যে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবেন এবং যেকোনো পরিণতির জন্য প্রস্তুত।

বিক্ষোভ সমাবেশে স্থানীয় নেতাদের বক্তব্য

বিক্ষোভ সমাবেশে আখাউড়া উপজেলা বিএনপি, পৌর বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের হাজারো নেতাকর্মী অংশ নেন। সমাবেশে স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও দাবি তুলে ধরেন।

বক্তব্য রাখেন:

  • আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন আব্দু (উপজেলা বিএনপির সভাপতি)
  • ডা. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া (উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক)
  • সেলিম ভূঁইয়া (পৌর বিএনপির সভাপতি)
  • আক্তার খান (পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক)
  • মহসিন আহমেদ ভূঁইয়া (উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব)
  • হুমায়ূন রহমান নয়ন (পৌর যুবদলের সদস্য সচিব)

নেতারা একযোগে দাবি করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে অবিলম্বে আলহাজ্ব কবির আহমেদ ভূঁইয়ার মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তারা হুঁশিয়ারি দেন যে, দাবি পূরণ না হলে তারা তাদের লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

মনোনয়ন বিতর্কের পূর্ব পটভূমি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনটি কসবা ও আখাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনটি ঐতিহ্যগতভাবেই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। অতীতেও এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কোন্দল দেখা গেছে।

  • মুশফিকুর রহমান: মনোনীত প্রার্থী মুশফিকুর রহমান দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হওয়ায় তার একটি কেন্দ্রীয় গুরুত্ব রয়েছে। অতীতে তিনি এই আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
  • কবির আহমেদ ভূঁইয়া: অন্যদিকে, আলহাজ্ব কবির আহমেদ ভূঁইয়া দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় দলের সাংগঠনিক কাজ দেখভাল করছেন এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও জনপ্রিয়তা রয়েছে।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনা না করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ

আখাউড়া-কসবার এই তীব্র বিদ্রোহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নির্বাচনের পূর্বে দলের অভ্যন্তরে এই ধরনের কোন্দল দলের সামগ্রিক ঐক্য ও নির্বাচনী ফলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

  • ঐক্য বজায় রাখা: দলীয় কোন্দল নিরসন করে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
  • নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হয় বিক্ষোভকারীদের দাবির বিষয়ে নমনীয় হতে হবে, নতুবা কঠোর হাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় এই বিরোধ অন্যান্য আসনেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিএনপির মতো বড় দলগুলোতে মনোনয়ন নিয়ে এই ধরনের বিদ্রোহ আরও বাড়তে পারে।

“আমাদের দাবি একটাই—ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনে মনোনয়ন দিতে হবে আলহাজ্ব কবির আহমেদ ভূঁইয়াকে। আর তা না হলে আমাদের আন্দোলন লাগাতারভাবে চালিয়ে যাব।” — আখাউড়া উপজেলা বিএনপির নেতাদের সম্মিলিত ঘোষণা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নকে কেন্দ্র করে মশাল মিছিল, সড়ক অবরোধ এবং কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ স্থানীয় রাজনীতির অস্থিরতাকে তুলে ধরেছে। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়, তৃণমূলের পছন্দ এবং নেতাদের প্রতি স্থানীয় কর্মীদের সমর্থনও অপরিহার্য। এই আসনে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম বহাল থাকবে, নাকি কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতৃত্ব কর্মীদের প্রবল দাবির মুখে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে—সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত দ্রুত সমাধান না হলে তা দলীয় ঐক্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এম আর এম – ২৩০৪,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button