ময়মনসিংহের নটরডেম কলেজের সাতজন স্থায়ী শিক্ষককে বহিষ্কার এবং দীর্ঘদিনের অভিযোগ ও অনিয়ম নিয়ে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে কলেজের শিক্ষক সমাজে। বহিষ্কৃত শিক্ষকরা দাবি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। এসব অভিযোগ প্রত্যাহার এবং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনসহ ছয় দফা দাবি পূরণ না হলে তারা আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন তারা।
ঘটনা/ঘোষণার বিস্তারিত
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বহিষ্কৃত রসায়ন বিভাগের প্রভাষক মোস্তাফিজার রহমান রানা। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক জহিরুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মাহামুদুল হাসান মামুন, জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহমুদ হাসান এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সাইফুল ইসলামসহ অন্যরা।
তারা বলেন, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে অনিয়ম, গ্র্যাচুইটি ফান্ডে দুর্নীতি, শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন না হওয়া, তথ্য গোপন, জবাবদিহিতার অভাবসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে কলেজে চলমান। এসব বিষয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে জেলা প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও সন্তোষজনক কোনো সমাধান না পাওয়ায় আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়।
বক্তব্যে বহিষ্কৃত শিক্ষকরা জানান, কলেজ কর্তৃপক্ষ পূর্বে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রাপ্য প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া শুরু হয়। সর্বশেষ অধ্যক্ষ ড. ফা. থাদেউস হেম্ব্রম প্রশাসনিক বিধি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সাত শিক্ষককে বহিষ্কার করেন।
পূর্বপটভূমি
গত ১৪ আগস্ট নটরডেম কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ১৯ দফা দাবি উত্থাপন করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। দাবি ছিল শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক অনিয়মের প্রতিকার।
সেদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন, স্মারকলিপি দেন এবং কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা হলেও সমস্যা মীমাংসা হয়নি। বরং আন্দোলনে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষককে পরবর্তীতে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়।
শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, শোকজের জবাব যথাযথভাবে দেওয়া হলেও দ্বিতীয় দফায় শোকজ দিয়ে তার ভিত্তিতে বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করা হয়, যা তারা অন্যায় বলে দাবি করেন।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
বহিষ্কারের ঘটনায় শিক্ষক মহলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, কারণ চলমান সেশনে সাতজন অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকলে পাঠদান কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বহিষ্কৃত শিক্ষকরা জানান, তাদের আমরণ অনশন শুরু হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তারা বলেন, এ পরিস্থিতির জন্য কলেজ প্রশাসনের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণই দায়ী।
অপরদিকে, কলেজের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিষ্ঠানটি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়ম মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে অধ্যক্ষ ড. ফা. থাদেউস হেম্ব্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
সংখ্যাগত তথ্য এবং তুলনা
শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কলেজের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ডে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ বছর ধরে চলে আসছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কয়েকজন শিক্ষক প্রমোশন না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে, যদিও নিয়ম অনুযায়ী ৫ বছর অন্তর প্রমোশন দেওয়ার কথা।
এ ধরনের অভিযোগ পূর্বেও দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে। তবে নটরডেম কলেজের ক্ষেত্রে ব্যাপক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্দোলনের মধ্যেই বহিষ্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় বিষয়টি আরও বিতর্ক তৈরি করেছে।
বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত
শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের প্রশাসনিক সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয় শিক্ষার্থীরা। তারা মনে করেন, কোনো শিক্ষক অনিয়ম করলে তার জন্য স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত এবং সব পক্ষের বক্তব্য শোনা প্রয়োজন।
শিক্ষা নীতি বিশ্লেষকদের মতে, অভিযোগ নিয়ে শিক্ষক ও প্রশাসনের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করায় এখানে একটি নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা জরুরি হয়ে গেছে। তারা মনে করেন, উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা পুনরায় শুরু না হলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ময়মনসিংহ নটরডেম কলেজে শিক্ষক-বহিষ্কার ইস্যু এখন বড় সংকটে রূপ নিয়েছে। একদিকে বহিষ্কৃত শিক্ষকদের অভিযোগ, অন্যদিকে কলেজ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত—দুই পক্ষের বক্তব্যেই রয়েছে জটিলতা। পরিস্থিতি সমাধানে এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত ও সংলাপ। দাবি মানা না হলে শিক্ষকদের ঘোষণা অনুযায়ী আমরণ অনশন শুরু হলে তা শিক্ষাঙ্গনে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, ঘটনাটির পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেয় প্রশাসন এবং আলোচনার কোনো নতুন পথ খুলে যায় কি না।
এম আর এম – ২২৯৪,Signalbd.com



