বাংলাদেশ

থামছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ, ঢাকা উত্তর সিটিতেই একদিনে ৫ মৃত্যু

Advertisement

দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ আবারও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, আর এর সবকটিই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়। একই সময়ে সারাদেশে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৯২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পরিস্থিতির আশঙ্কাজনক চিত্র, যা ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখনো একটি বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিরাজ করছে। বিশেষ করে রাজধানীভিত্তিক এলাকাগুলোতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ মৃত্যু এবং শত শত নতুন আক্রান্তের তথ্য বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিক সচেতনতায় ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

মৃত্যু ও শনাক্ত: সর্বশেষ পরিস্থিতি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মৃত পাঁচজনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। চলতি বছর এ নিয়ে সারা দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩১ জনে। নতুন আক্রান্ত ৭৯২ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেই একদিনে ভর্তি হয়েছে ২২৬ জন। ঢাকার অন্য অংশ (ঢাকা দক্ষিণ সিটি) থেকেও ভর্তি হয়েছে ১২১ জন। ঢাকা বিভাগ (সিটি এলাকার বাইরে) থেকে ১০৭ জন, চট্টগ্রামে ১৩৬ জন, বরিশালে ১২৫ জন, ময়মনসিংহে ৬০ জন, খুলনা অঞ্চলে ১৫ জন এবং সিলেটে ২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ডেঙ্গুর বিস্তার: কোথায় সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লেও রাজধানী ঢাকার অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া, ড্রেনেজ সমস্যা এবং অপরিকল্পিত আবাসিক ও নির্মাণকাজকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এডিস মশার বিস্তার বেশি হওয়ায় আক্রান্তের হারও সবচেয়ে বেশি। মশা নিয়ন্ত্রণে অভিযান জোরদার হলেও তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে ওঠেছে প্রশ্ন।

আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা

ডেঙ্গুর ইতিহাস বলছে, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে এবং আক্রান্তের সংখ্যা তুঙ্গে ওঠে। তবে গত কয়েক বছর ধরে বর্ষার বাইরেও ডেঙ্গুর প্রভাব তীব্র আকারে দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরও সেই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

অতীতের তথ্য অনুযায়ী, কিছু বছর আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও মৃত্যুর হার বেশি ছিল। এবার আক্রান্তের সংখ্যা যেমন ব্যাপক, তেমনি মৃত্যুও উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডাক্তারদের ভাষ্য, রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসা, জটিলতা বাড়া এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

ডেঙ্গুর প্রভাবে হাসপাতালগুলোতে চাপ

রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বেড়েছে। অনেক হাসপাতালেই আইভি ফ্লুইড, প্লাটিলেট ব্যাগ, ওয়ার্ড বেডের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের বেড সংকটের কারণে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে, জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতেও একই চাপ দেখা যাচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বাড়ায় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।

পরিসংখ্যান: পুরুষ-নারী আক্রান্তের অনুপাত

চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৮৩ হাজার ৮৫০-এর বেশি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে। এর মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশই পুরুষ এবং ৩৮ শতাংশ নারী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইরে কাজ করেন এমন পুরুষরা এডিস মশার সংস্পর্শে বেশি আসেন, তাই আক্রান্তের হার পুরুষদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি।

এছাড়া ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮০ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী। যদিও ছাড়পত্রের সংখ্যা অনেক, তবে প্রতিদিনই নতুন রোগী আসায় সার্বিক চাপে কোনো স্বস্তি মিলছে না।

মতামত: কেন থামছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ

মশাবাহিত রোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ঘাটতি ও সচেতনতার অভাবই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াচ্ছে। তারা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নাগরিকদেরও ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, পানি জমে না থাকা, মচ্ছার প্রজননস্থল ধ্বংস রাখার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা উল্লেখ করেন, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা এবং নির্মাণাধীন ভবনগুলোর অযত্নই এডিস মশার বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখছে।

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সঠিক সময়ে কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে। রাজধানীতে ধারাবাহিক মৃত্যুর ঘটনা এবং সারাদেশে বাড়তে থাকা রোগীর সংখ্যা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি উদ্যোগ, স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা এবং জনগণের সচেতনতার সমন্বয় ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এম আর এম – ২২৩৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button