রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আজ পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলনকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের ঢল নামে ভোর থেকেই। মূল আলোচনার কেন্দ্রে ছিল কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি, যা ঘিরে দেশি-বিদেশি আলেমদের ব্যাপক উপস্থিতি নজর কাড়ে।
ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলনকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের উপস্থিতিতে উদ্যান এক পর্যায়ে পুরোপুরি জনসমুদ্রে রূপ নেয়। সম্মেলনে বক্তারা কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবি তুলে ধরেন এবং সরকারের কাছে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার আহ্বান জানান। দেশি-বিদেশি শীর্ষ আলেমদের অংশগ্রহণে সম্মেলন হয়ে ওঠে আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিকে কেন্দ্র করে বিশাল জমায়েত
মহাসম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কাদিয়ানি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি। ভোর ফজরের নামাজের পর থেকেই দেশের নানা অঞ্চলের মানুষ দলে দলে সোহরাওয়ার্দীর পথে রওনা হন। কেউ বাসে, কেউ ট্রাকে, কেউবা হাঁটিয়েই সম্মেলনস্থলে এসে যোগ দেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো উদ্যান জুড়ে স্লোগান, নসিহত এবং বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুনে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
আয়োজকরা জানান, ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় মহলে আলোচনায় রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ব্যাপক সমাবেশের মাধ্যমে বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের সামনে তুলতে চান তারা। আয়োজকদের ভাষ্য, এতে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যাই প্রমাণ করে যে বিষয়টি জনমনে কতটা গুরুত্ব বহন করে।
দেশি-বিদেশি আলেমদের উপস্থিতি সম্মেলনকে নতুন মাত্রা দেয়
সম্মেলনে বিশ্বের খ্যাতনামা বহু আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের উপস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের শীর্ষ নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল মুফতি আবুল কাসেম নোমানী, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা মাহমুদ মাদানীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী আলেমরা মঞ্চে বক্তব্য রাখেন।
মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শায়েখ মুসআব নাবীল ইবরাহীম এবং সৌদি আরবের ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্টের প্রতিনিধিরাও অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বক্তাদের বক্তব্যে নবুওয়তের চূড়ান্ততা, মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস রক্ষার দায়বদ্ধতা এবং কাদিয়ানি ইস্যুতে বিশ্ব মুসলিম নেতাদের অবস্থান উঠে আসে।
দেশীয় আলেমদের অবস্থান ও বক্তব্য
বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনের শীর্ষ আলেমরাও সম্মেলনে অংশ নেন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, দারুল উলুম হাটহাজারীর মুহতামিম মাওলানা খলিল আহমাদ কুরাইশী, বেফাকুল মাদারিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানসহ বিশিষ্ট আলেমরা মঞ্চে উপস্থিত থেকে নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন।
তাদের বক্তব্যে মূলত নবুওয়তের মর্যাদা রক্ষা, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং কাদিয়ানি ইস্যুতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। অনেকেই সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিষয়টি পর্যালোচনা করে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।
দীর্ঘদিনের দাবি ও বিতর্ক
কাদিয়ানি সম্প্রদায় নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন বহু বছর ধরে তাদেরকে মূলধারার মুসলিম সমাজের বাইরে মনে করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে বিষয়টি সামাজিক ও ধর্মীয় আলোচনায় থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি।
ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর দাবি, কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের কিছু বিশ্বাস ইসলামের মূলধারার আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা প্রয়োজন। অন্যদিকে মানবাধিকারকেন্দ্রিক কয়েকটি সংগঠন মনে করে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নিলে তা সামাজিক প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আজকের এই মহাসম্মেলনকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখছেন।
লাখো মানুষের উপস্থিতিতে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
আজকের সম্মেলনে লাখো মানুষের উপস্থিতি সমাজে বিষয়টির গুরুত্বকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যানজট সৃষ্টি হয়, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, জনসমাগমের কারণে এলাকার দোকানপাটে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ভিড় দেখা যায়।
রাজনৈতিক মহলেও সম্মেলন নিয়ে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন দলের কিছু নেতা সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখবেন বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এত বড় জনসমাবেশ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।
সমাজে প্রভাব ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের দাবি, এই ধরনের বিশাল আকারের সম্মেলন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। তবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনগত বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আসতে পারে। একজন ইসলামি চিন্তাবিদ বলেন, খতমে নবুওয়ত আকিদা রক্ষার দাবি বিশ্ব মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিনের, তাই বিষয়টি সংবেদনশীল। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা প্রয়োজন।
দিনভর আয়োজিত এই মহাসম্মেলন ধর্মীয় অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যেও গভীর প্রভাব ফেলছে। এখন নজর থাকবে সরকারের দিকে, তারা এ দাবির প্রতি কী অবস্থান নেয়। বিশ্লেষকদের মতে, আগামীর পরিস্থিতি নির্ভর করবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ২২৩৭,Signalbd.com



