প্রযুক্তি

ফ্রিডম হাউসের রিপোর্ট, ইন্টারনেট স্বাধীনতায় নজিরবিহীন অগ্রগতি

Advertisement

ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম অন দ্য নেট-২০২৫’ প্রতিবেদনে উঠে এল বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতার উন্নয়ন

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফ্রিডম হাউস সম্প্রতি প্রকাশ করেছে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফ্রিডম অন দ্য নেট-২০২৫’, যেখানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতায় বড় অগ্রগতি ধরা পড়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাংলাদেশের অনলাইন স্বাধীনতা অনেকাংশে উন্নত হয়েছে।

ইন্টারনেট স্বাধীনতায় শীর্ষ অগ্রগতি বাংলাদেশে

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে ৭২টি দেশের অনলাইন স্বাধীনতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা নিরীক্ষণ করে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার সূচক ১০০-এর মধ্যে ৪৫ এ উন্নীত হয়েছে, যেখানে গত বছরের স্কোর ছিল ৪০। এই ৫ পয়েন্টের উন্নতি বাংলাদেশের গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান নির্দেশ করে।

ফ্রিডম হাউসের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অগ্রগতি মূলত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান এবং এর পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের ডিজিটাল সংস্কারের ফল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন ছিল, যা ডিজিটাল স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এরপর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার অনলাইনে কিছু ইতিবাচক সংস্কার আনে, যা ইন্টারনেট স্বাধীনতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আংশিক মুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ

উন্নতির পরও, ফ্রিডম হাউস বাংলাদেশকে এখনো ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ এই অবস্থানেই রয়েছে। অর্থাৎ, স্বাধীনতার সূচক বাড়লেও এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।

ফ্রিডম হাউস তিনটি মূল সূচকের মাধ্যমে দেশের অনলাইন স্বাধীনতা নির্ধারণ করে:

  1. ইন্টারনেটে প্রবেশের বাধা
  2. অনলাইনে প্রকাশিত বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ
  3. ব্যবহারকারীর অধিকার লঙ্ঘন

এই তিনটি বিভাগের মধ্যে মোট ২১টি সূচক ব্যবহার করে প্রতিটি দেশের অনলাইন স্বাধীনতার মাত্রা মূল্যায়ন করা হয়।

সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে নতুন অধ্যাদেশ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ চলতি বছরের মে মাসে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) বাতিল করেছে। এর পরিবর্তে নতুনভাবে সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ (সিএসও) প্রবর্তিত হয়েছে।

নতুন অধ্যাদেশে অনলাইনে হয়রানি ও যৌন শোষণের বিরুদ্ধে কিছু ইতিবাচক বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে, বিষয়বস্তু অপসারণ, অনলাইন মন্তব্যের জন্য ফৌজদারি শাস্তি এবং নজরদারি সংক্রান্ত কিছু উদ্বেগজনক নিয়ম আগের মতোই বহাল রয়েছে।

বিশ্বের সেরা ও তলানির দেশগুলো

প্রতিবেদনে ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড সর্বোচ্চ স্কোর ৯৪ পেয়ে বিশ্বের সেরা অনলাইন স্বাধীনতা দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপরে যথাক্রমে ইউরোপের এস্তোনিয়া (৯১ স্কোর) ও দক্ষিণ আমেরিকার চিলি (৮৭ স্কোর) অবস্থান করছে। এই তিন দেশকে ‘মুক্ত’ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে মিয়ানমার মাত্র ৯ স্কোর পেয়ে তালিকায় তলানিতে রয়েছে এবং দেশটিকে ‘মুক্ত নয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ৪৫ পয়েন্ট নিয়ে ‘আংশিক মুক্ত’ অবস্থানে রয়েছে। একই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো হল:

  • শ্রীলঙ্কা: ৫৩ পয়েন্ট, আংশিক মুক্ত
  • ভারত: ৫১ পয়েন্ট, আংশিক মুক্ত
  • পাকিস্তান: ২৭ পয়েন্ট, মুক্ত নয়

ফ্রিডম হাউসের বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের এই উন্নতি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের স্বাধীনতায় ইতিবাচক পরিবর্তনের ফল

প্রযুক্তি ও গণতন্ত্রের সমন্বয়

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইন স্বাধীনতা মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণ, সেন্সরশিপ, নজরদারি ও ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তি এবং গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা গেছে। অনলাইন স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাওয়া মানে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করার স্বাধীনতা নয়, বরং ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার, তথ্যের স্বচ্ছতা, সাইবার নিরাপত্তা, এবং ব্যবহারকারীর অধিকার রক্ষা-এর প্রতিফলন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশকে পূর্ণ মুক্ত দেশে পরিণত করতে হলে অনলাইন সেন্সরশিপ হ্রাস, সাইবার আইন পুনর্গঠন, এবং তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহার ও উদ্ভাবনী প্রকল্প

বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের অধীনে সম্প্রতি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • উন্নত ব্রডব্যান্ড সংযোগ, যা গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়াচ্ছে
  • সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি
  • ডিজিটাল নাগরিক সেবা ও ই-গভর্নেন্স

এসব প্রকল্পে সরকারের লক্ষ্য, ইন্টারনেটকে শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক ও সামাজিক উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উন্নীত করা।

বিশ্বমানের ইন্টারনেট স্বাধীনতার চিত্র

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ব্যবধান বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ:

  • মুক্ত দেশ: আইসল্যান্ড, এস্তোনিয়া, চিলি
  • আংশিক মুক্ত দেশ: বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত
  • মুক্ত নয় দেশ: মিয়ানমার, পাকিস্তান

এই সূচক বিশ্বকে দেখায় কোন দেশ ডিজিটাল অধিকার রক্ষায় কতটা অগ্রগামী এবং কোন দেশ এখনও সেন্সরশিপ ও নিয়ন্ত্রণের শিকার।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট স্বাধীনতার সাফল্য ধারাবাহিক রাখতে হলে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:

  1. ডিজিটাল আইন পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক সংস্কার
  2. সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যবহারকারীর অধিকার সমন্বয়
  3. ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি
  4. শিক্ষার্থী ও তরুণদের নেতৃত্বে উদ্ভাবনী ডিজিটাল উদ্যোগ উৎসাহিত করা

বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার এই ইতিবাচক পরিবর্তন দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজে ডিজিটাল উদ্ভাবনকে শক্তিশালী করবে।

MAH – 13803 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button