মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্রুত বাড়তে থাকা খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই শতাধিক খাদ্যপণ্যের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কফি, কলা, টমেটো, অ্যাভোকাডো, দুগ্ধজাত পণ্য, নানা ধরনের ফল, নারিকেল ও গরুর মাংসসহ জনপ্রিয় খাদ্যপণ্যের একটি দীর্ঘ তালিকা এতে অন্তর্ভুক্ত। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি এ বিষয়ে একটি বিশেষ নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। খবর—রয়টার্স।
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে এই শুল্কছাড় কার্যকর করা হয়েছে, এবং এটিকে “মূল্য স্থিতিশীলতার জরুরি পদক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করেছে প্রশাসন।
কেন এই সিদ্ধান্ত? ট্রাম্প বললেন—“দাম খুব বেশি, মানুষ চাপে আছে”
শুক্রবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন,
“আমরা কিছু নির্দিষ্ট খাদ্যপণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করেছি, বিশেষ করে কফির মতো পণ্য যেখানে দাম অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। মানুষ চাপে আছে, তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল।”
গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মুদি পণ্য, গরুর মাংস ও তাজা ফলমূলের দাম ১২–১৮% পর্যন্ত বেড়েছে বলে স্থানীয় বাজার বিশ্লেষকদের তথ্য। এতে সাধারণ মানুষ যেমন সমস্যায় পড়ছে, তেমনই রাজনীতিতেও তা ট্রাম্পের জন্য বড় চাপ তৈরি করেছিল।
৫০টি দেশ থেকে আমদানি—যা যুক্তরাষ্ট্রে পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না
ট্রাম্প প্রশাসনের দেওয়া তালিকায় রয়েছে প্রায় ২১০টি খাদ্যপণ্য, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না। এসব পণ্য আমদানি করা হয় ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে।
হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“দেশীয় কৃষি উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা এবং বাজারের চাহিদা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে এসব পণ্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই শুল্ক কমানো হলে সরবরাহ বাড়বে, দাম স্থিতিশীল হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি শিল্প শক্তিশালী হলেও কফি, কলা, কোको, ট্রপিক্যাল ফল, অনেক সবজি, এমনকি নির্দিষ্ট প্রজাতির মাংস দেশটিতে পর্যাপ্ত হয় না।
মূল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কী ঘটছে?
যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক মাস ধরে খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছিল। বিশেষ করে—
- কফি
- মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য
- ফলমূল
- টমেটো, ঝাল মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজি
এসব পণ্যের দামে ২০–৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি দেখা গেছে। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—
- আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ হ্রাস
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
- পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি
- উৎপাদনকারী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা
- আমদানি শুল্কের অতিরিক্ত চাপ
খাদ্যদাম বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। অনেক জায়গায় মুদি দোকানের সামনে বিক্ষোভও হয়েছে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসন রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়েছিল।
ট্রাম্পের আগের অভিযোগ: “গরুর মাংস কোম্পানিগুলো দাম কারসাজি করছে”
এর আগে গত সপ্তাহে ট্রাম্প সরাসরি মার্কিন মাংস-প্যাকিং কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন—
“কিছু কোম্পানি অবৈধভাবে দাম বাড়াচ্ছে, একসঙ্গে মিলেমিশে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।”
তিনি এ শিল্পে তদন্তের নির্দেশ দেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বক্তব্যের পর সামাজিক চাপ আরও বেড়ে গেলে হোয়াইট হাউজ দ্রুত বড় পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যায়।
কোন কোন পণ্য শুল্কমুক্ত হলো—সংক্ষেপে তালিকা
যদিও প্রশাসন পুরো ২ শতাধিক পণ্যের বিস্তারিত তালিকা এখনও প্রকাশ করেনি, তবে বিভিন্ন সরকারি সূত্র জানিয়েছে, যেসব পণ্য নিশ্চিতভাবে তালিকায় রয়েছে:
শস্য ও পানীয় উপাদান
- কফি বিন
- কোको
- চা
- বার্লি, ওটস ও বিশেষ শস্য
- কোকোনাট ওয়াটার উপাদান
ফল ও সবজি
- অ্যাভোকাডো
- টমেটো
- কলা
- কমলা, লেবু
- আম
- আনারস
- পেঁপে
- নারিকেল
- ঝাল মরিচ
- পেঁয়াজ, রসুন
- লেটুস ও সালাদ উপাদান
মাংস ও প্রাণিজ পণ্য
- গরুর মাংস
- ভেড়ার মাংস
- মাছের বিশেষ প্রজাতি
- প্রক্রিয়াজাত মাংসপণ্য
অন্যান্য উপকরণ
- বেকারি-উপকরণ
- ক্যানজাত খাদ্য
- রান্নার তেল
- কনসেন্ট্রেট জুস
- হিমায়িত সবজি
এই তালিকার পরিধি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বিশ্ববাজারে এর প্রভাব কী হবে?
বিশ্ববাজারের দৃষ্টিকোণ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি খাদ্যপণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তারা শুল্ক কমালে—
- আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহের চাপ কমবে
- উৎপাদক দেশগুলোর রপ্তানি আয় বাড়বে
- বিশ্বব্যাপী খাদ্যদামের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে
ল্যাটিন আমেরিকায় অ্যাভোকাডো, মধ্য আমেরিকায় কলা, ব্রাজিল-কোলাম্বিয়ায় কফি, এশিয়ায় ফলমূল রপ্তানিকারক দেশগুলো এতে সরাসরি উপকৃত হবে।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত: “স্বল্পমেয়াদে ভালো, দীর্ঘমেয়াদে কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে”
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুল্ক কমালে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তা তাৎক্ষণিকভাবে উপকৃত হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় কৃষকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অসুবিধায় পড়তে পারেন।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক অর্থনীতিবিদ জানান—
“যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন হয় না, তাদের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো যৌক্তিক। তবে যেসব পণ্য আংশিকভাবে উৎপাদন হয়, সেগুলো আমদানি বেড়ে গেলে স্থানীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সরকারকে সেক্টরভেদে আলাদা নীতি নিতে হবে।”
ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান: “দেশীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না”
ট্রাম্প বলেছেন—
“আমাদের কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলোর ওপর কোনো নীতি শিথিল করা হয়নি।”
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, ভবিষ্যতে দেশীয় কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজও দেওয়া হতে পারে।
আমেরিকান জনগণের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন। সাধারণ ভোক্তারা বলছেন—
- “খাদ্যদাম কমানোর জন্য এটা দরকার ছিল।”
- “প্রতিদিনের বাজার খরচ কমবে আশা করি।”
তবে বিরোধীরা বলছেন—
- “এটি নির্বাচনী কৌশল।”
- “হঠাৎ শুল্ক কমানো মানে দেশীয় কৃষকদের অস্থিতিশীলতা।”
আগামী মাসে মূল্য কমার সম্ভাবনা—বাজার বিশেষজ্ঞদের মত
মার্কিন বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস—
- এ সিদ্ধান্তের ফলে আগামী ৪–৬ সপ্তাহের মধ্যে মুদি পণ্যের দাম ৫–১২% পর্যন্ত কমতে পারে।
- কফি ও টমেটোর মতো দ্রব্যের দাম দ্রুত কমতে পারে।
- মাংস ও অন্যান্য ভারী পণ্যে প্রভাব পড়তে আরও সময় লাগবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, ভারত, ভিয়েতনামসহ বড় রপ্তানিকারক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে—
- যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আরও উন্মুক্ত হলে রপ্তানি বাড়বে
- কৃষকদের আয় বাড়বে
- শ্রমবাজারে উন্নতি হবে
মেক্সিকোর কৃষিমন্ত্রী বলেছেন—
“অ্যাভোকাডো রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার। শুল্ক কমানো মানে আমাদের কৃষকদের জন্য বিশাল সুযোগ।”
ট্রাম্পের আগের নীতি থেকে কীভাবে আলাদা?
ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে (২০১৭–২০২১) আমদানির ওপর নানা শুল্ক বাড়িয়ে “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তখন চীন থেকে আমদানির ওপর বড় শুল্কারোপ করা হয়। কিন্তু এবার তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটছেন।
বিশ্লেষকদের মতে—
“ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্যদাম স্থিতিশীল রাখা। তাই তিনি আগের মত নীতির পুনর্বিবেচনা করছেন।”
বাজার এখন কী আশা করতে পারে?
আগামী সপ্তাহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সুপারশপ ও মুদি দোকানগুলোতে—
- অধিক আমদানি
- সরবরাহ বাড়া
- পাইকারি বাজারে চাপ কমা
—এসব দেখা যেতে পারে। তবে স্থিতিশীল হতে সময় লাগবে বলে মনে করেন অনেকেই।
মার্কিন বাজারে ক্রমবর্ধমান খাদ্যদাম ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় চাপ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে দুই শতাধিক খাদ্যপণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা, রপ্তানিকারক দেশ এবং বিশ্ববাজার—সব জায়গায় প্রভাব ফেলবে।
তাৎক্ষণিকভাবে দামের চাপ কমলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় কৃষক, উৎপাদক ও বাজার কাঠামোর ওপর এর প্রভাব কী হবে—সেটি সময়ই বলে দেবে।
MAH – 13798 I Signalbd.com



