গাজীপুরের কোনাবাড়ী নওয়াব আলী মার্কেট এলাকার একটি আবাসিক ভবনে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। শনিবার সকালে একতা ভিলা নামের পাঁচতলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে গলা কাটা অবস্থায় গৃহবধূ রহিমা খাতুনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঠিক তাঁর পাশেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন স্বামী এমরান হোসেন। প্রথমে তাঁকে মৃত মনে হলেও পরে ক্ষীণ পালস পাওয়া যায়। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা—দীর্ঘদিনের দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যার পর এমরান নিজেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী তাদের ১৬ বছরের মেয়ে শারমিন। তার শারীরিক-মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
ঘটনার খবর মুহূর্তেই আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কোনাবাড়ী—যে এলাকা শিল্প-কারখানা, ব্যস্ততা ও মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মানুষের ভিড়ে সরব—সেখানকার বাসিন্দারা আজ ভোরের সেই নারকীয় দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ।
পরিবারটি একতা ভিলায় ভাড়া থাকত—শান্ত স্বভাবের পরিবার মনে করত সবাই
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমরান হোসেন (৪০) পেশায় স্থানীয় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আমতলা গ্রামে। স্ত্রী রহিমা খাতুন (৩৫) গৃহিণী। তাদের একমাত্র সন্তান শারমিন দশম শ্রেণিতে পড়ে।
প্রতিবেশীরা জানায়—
“ওদের ঝগড়া-বিবাদ কখনো শুনিনি। খুব সাধারণ, শান্ত স্বভাবের পরিবার ছিল। এভাবে ঘটতে পারে—বিশ্বাসই হয় না।”
কিন্তু শারমিন জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে বাবা-মায়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য চলছিল। কখনো আর্থিক সংকট, কখনো ব্যক্তিগত সন্দেহ, আবার কখনো পারিবারিক সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠত।
ভোরের সেই শেষ মুহূর্ত—মেয়ের বর্ণনায় উঠে আসছে ভয়াবহ সত্য
পুলিশকে দেওয়া শারমিনের বয়ানে যা উঠে এসেছে তা আরও মর্মান্তিক।
ভোররাতে বাবা-মায়ের তীব্র কথাকাটাকাটি হচ্ছিল। হঠাৎ বাকবিতণ্ডা রূপ নেয় ভয়ানক সহিংসতায়। শারমিনের ভাষ্যমতে—
“আমি ঘরে ছিলাম। মা চিৎকার করছিলেন। দরজা খুলে দেখি বাবা হাতে দা নিয়ে মাকে আঘাত করছে। আমি ভয় পেয়ে বাইরে দৌড়ে যাই। পরে বাবাকেও রক্তাক্ত অবস্থায় দেখি।”
এক্ষেত্রে মেয়েটির মানসিক অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে—মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রয়োজন হলে তার দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত: হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা
কোনাবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন জানান—
“রহিমা খাতুনকে ধারালো দা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর স্বামীও একই অস্ত্র দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে ধারণা। ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা দা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি এখনও জীবিত, তবে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসায় রেফার করা হবে।”
ওসি সালাউদ্দিন আরও বলেন—
“বাড়ির ভেতরে জোরপূর্বক প্রবেশের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অতএব এটি বাইরের কারও কাজ নয় বলেই মনে হচ্ছে। পারিবারিক কলহই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হতে পারে।”
প্রতিবেশীরা কী দেখেছেন?
ঘটনার সময়ে আশপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা শুধু চিৎকারের শব্দ শুনেছেন। পরে শিশুটির কান্না ও চিৎকারে সবাই জড়ো হয়। একজন বাসিন্দা বলেন—
“দরজা খানিকটা খোলা ছিল। ভেতরে উঁকি দিতেই দেখি রক্তে ভেজা ফ্লোরে বউয়ের মরদেহ। পাশে স্বামী পড়ে আছে। আমরা প্রথমে দুজনকেই মৃত ভেবেছিলাম।”
আরেকজন বলেন—
“ফ্যান চলছিল, ঘর এলোমেলো নয়। তাই মনে হচ্ছিল আচমকাই ঘটনা ঘটেছে।”
এমরান কি মানসিক চাপে ছিলেন?—পরিবারের অভিযোগ ও অতীত সংঘাত
রহিমার এক আত্মীয় জানিয়েছেন, স্বামীর আচরণে কয়েক বছর ধরে অস্থিরতা ছিল। তিনি বেশিরভাগ সময়ই চাপের মধ্যে থাকতেন। কাজের চাপ, আর্থিক টানাপোড়েন ও পারিবারিক দুশ্চিন্তা নিয়ে বেশ রাগী হয়ে উঠেছিলেন।
তবে এমরানের পরিবার দাবি করছে—
“ও খুব শান্ত ছেলে। এমন ঘটনা সে করতে পারে না। হয়তো নিজেকে বাঁচাতে কেউ তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
যদিও পুলিশের তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই সব সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি
এই হত্যাকাণ্ডটি একা নয়—বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ ও মানসিক চাপে ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বছরে শত শত নারী স্বামীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণ—
- আর্থিক চাপ
- পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব
- সন্দেহ ও বিশ্বাসঘাটতি
- মানসিক অস্থিরতা
- সামাজিক দায়িত্বের চাপ
- নেশাজনিত সমস্যা
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন—
“দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে পড়ার আগে অনেক সংকেত থাকে। তার কোনোটিই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। না পরিবার, না সমাজ।”
ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া আলামতগুলো—তদন্ত দ্রুত এগোচ্ছে
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে যা যা উদ্ধার করেছে:
- একখানা ধারালো দা
- রক্তমাখা পোশাক
- রক্তের নমুনা
- মোবাইল ফোন
- দরজার তালা ঠিকঠাক থাকা প্রমাণ
- শিশুটির বিবৃতি
এ ছাড়া ভবনের সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করা হচ্ছে। যদিও ভবনের ভেতরে ক্যামেরা নেই, তবে প্রবেশ-দ্বারের ক্যামেরায় রাতভর কোন অস্বাভাবিক প্রবেশ-বহির্গমন দেখা যায়নি।
মেয়েটির ভবিষ্যৎ—রাষ্ট্র বা আত্মীয়ের দায়িত্ব?
শারমিন মাত্র ১৬ বছরের কিশোরী। সে চোখের সামনে নিজের মাকে হত্যা হতে দেখেছে। বাবা এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বয়সে এমন ঘটনা দেখা মানসিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান—
“মেয়েটির সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নেওয়া হবে, কিংবা নিকট আত্মীয়দের কাছে দায়িত্ব দেওয়া হবে।”
ময়নাতদন্তে কী বেরোতে পারে?
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ একটি সম্ভাব্য বিশ্লেষণে বলেছেন—
- ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে আঘাতের ধরন নিশ্চিত হবে
- মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যাবে
- আগে কোন শারীরিক নির্যাতন হয়েছে কি না বোঝা যাবে
- প্রতিরোধের চিহ্ন থাকলে বোঝা যাবে রহিমা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন কি না
এই রিপোর্ট তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আইনগত ব্যবস্থা কী হবে?
ওসি সালাউদ্দিন জানিয়েছেন—
- হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে
- এমরান সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে
- পরিবারের বক্তব্য নেওয়া হবে
- মেয়েটির মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা নিশ্চিত করা হবে
স্থানীয়দের শোক—‘এমন ঘটনা আগে কখনও দেখিনি’
পাশের দোকানদার বলেন—
“রহিমা আপা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতেন, বাজার করতেন। কারও সঙ্গে ঝগড়ার কথা শুনিনি।”
মানুষের মুখে মুখে একটাই প্রশ্ন—একটি মধ্যবিত্ত শান্ত পরিবারের মধ্যে এমন ভয়াবহ ঘটনার জন্ম কীভাবে?
সামাজিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
“পারিবারিক সমস্যার গভীরতা মানুষ প্রকাশ করে না। চাপ জমতে জমতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটে।”
মানবাধিকার কর্মীদের মন্তব্য—‘এটি কেবল পরিবারের ক্ষতি নয়, সমাজের ক্ষতি’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন—
“এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সামাজিক রোগ। এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা, পরামর্শ, কাউন্সেলিং এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।”
গাজীপুরের এই হত্যাকাণ্ড আবারও মনে করিয়ে দিল—পারিবারিক কলহ কোন ছোট বিষয় নয়। সময়মতো সমাধান না হলে তা বড় ট্র্যাজেডিতে রূপ নিতে পারে।
একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল, একটি কিশোরী জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় দেখে ফেলল। আর একটি সমাজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আরেক নৃশংস ঘটনার দিকে।
MAH – 13796 I Signalbd.com



