বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে— এমন আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, “বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের হতে হবে আরও দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও প্রস্তুত।”
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর ২০২৫) রাজশাহী সেনানিবাসে বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ২০তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে গুরুত্বারোপ
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, “একুশ শতকের যুদ্ধ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগের শতাব্দীর তুলনায় অনেক জটিল। যুদ্ধের ধরন বদলেছে— এখন এটি শুধু মাঠে বন্দুকধারীদের লড়াই নয়, বরং প্রযুক্তি, তথ্য, গোয়েন্দা এবং সাইবার যুদ্ধের সমন্বয়।”
তিনি উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা— এগুলিই এখন সময়ের দাবি।
প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের ওপর জোর
বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট (BIR)-এর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, “প্রতিটি সৈনিকই জাতির সম্পদ। তাঁদের প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও মনোবল যত উন্নত হবে, দেশের প্রতিরক্ষা তত শক্তিশালী হবে।”
তিনি কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষণা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় উৎসাহিত হওয়ার পরামর্শ দেন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আরও বলেন, “আমাদের রেজিমেন্ট শুধু অস্ত্রধারী বাহিনী নয়, এটি একটি মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি। তাই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে সুশৃঙ্খল, পেশাদার ও দায়িত্বশীল।”
ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা স্মরণ
সম্মেলনে সেনাপ্রধান বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, “এই রেজিমেন্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের প্রতিটি দুর্যোগে, শান্তি রক্ষায়, জাতিসংঘ মিশনে— ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের সদস্যরা তাঁদের সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের ছাপ রেখেছেন।”
তিনি রেজিমেন্টের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান— এই ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
মতবিনিময় পর্বে সেনাপ্রধান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি স্মার্ট, প্রযুক্তি-নির্ভর, আত্মনির্ভরশীল সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা ও উন্নয়ন।”
তিনি আরও জানান, সেনাবাহিনীতে আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন, ড্রোন ও সাইবার প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ সহযোগিতা জোরদার করার পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “আজকের বিশ্বে সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনারা যে দক্ষতা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করছে, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়, এটি দেশের উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে একটি নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর রূপান্তর
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বর্তমানে ডিজিটাল ট্রেনিং সিস্টেম, ভার্চুয়াল সিমুলেশন, এবং স্মার্ট কমিউনিকেশন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি না, আমরা একটি দায়িত্বশীল, শিক্ষিত ও নৈতিক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চাই। সেনারা যেন দেশের প্রতিটি সংকটে জনগণের পাশে দাঁড়ায়, এটাই আমাদের লক্ষ্য।”
সেনাপ্রধানকে অভ্যর্থনা ও সম্মাননা
সম্মেলনের শুরুতে সেনাপ্রধান রাজশাহীর বিআইআরসি (Bangladesh Infantry Regimental Centre) সম্মেলন কক্ষে পৌঁছালে তাঁকে স্বাগত জানান ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। পরে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সম্মেলনে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ডার ও সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ভূমিকা
বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা এবং সেনাবাহিনীতে আধুনিক ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটের প্রয়োজন মেটানো।
গত দুই দশকে এই রেজিমেন্ট দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, সীমান্তে টহল, শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে রেজিমেন্টের সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে দেশের গৌরব বাড়াচ্ছে।
সেনাপ্রধানের বার্তা: ‘দেশের প্রতি অঙ্গীকারই সর্বোচ্চ প্রেরণা’
বক্তৃতার শেষ অংশে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “আমাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তি যত আধুনিকই হোক না কেন— সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আমাদের দেশপ্রেম ও অঙ্গীকার। দেশের মাটি, মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষাই আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।”
তিনি সবাইকে আহ্বান জানান— নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে।
একুশ শতকের পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধরন প্রতিদিনই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সেই বাস্তবতায় সেনাপ্রধানের এই আহ্বান শুধু একটি রেজিমেন্টের প্রতি নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও পেশাদারিত্বে অগ্রসর হয়, তাহলে দেশ শুধু নিরাপদই হবে না— বরং বিশ্ব অঙ্গনে আরও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
MAH – 13789 I Signalbd.com



