জাতীয়

জানালেন প্রধান উপদেষ্টা গণভোটে যে চার প্রশ্ন থাকবে

Advertisement

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হবে একটি ঐতিহাসিক গণভোট—যেখানে জনগণ প্রথমবারের মতো সরাসরি অংশ নেবে সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে। এই গণভোটে চারটি মৌলিক ও ভবিষ্যত নির্ধারক প্রশ্ন থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) দুপুর আড়াইটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বিশেষ ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “গণভোট হবে আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রার নতুন সূচনা। এখানে জনগণ নিজ হাতে নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো কেমন হবে।”

গণভোটে থাকবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জানান, জুলাই সনদে যে প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে গৃহীত হয়েছে, সেগুলোই গণভোটে উপস্থাপন করা হবে একটি সংযুক্ত প্রশ্ন আকারে।

ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানাবেন তারা এসব প্রস্তাবের পক্ষে নাকি বিপক্ষে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন, তবে আগামী সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকার সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করবে।

প্রথম প্রস্তাব: নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় গঠন করা হবে।
এর লক্ষ্য হলো—নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করা। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছিল, এবার সেই দাবিই গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাবে জনগণের হাতে।

দ্বিতীয় প্রস্তাব: দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ

দ্বিতীয় প্রস্তাবে দেশের সংসদ কাঠামোয় বড় পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট। তবে প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট

  • নিম্নকক্ষ থাকবে আগের মতো সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে।
  • উচ্চকক্ষ গঠিত হবে বিভিন্ন দলের জাতীয় ভোটের শতকরা হার অনুযায়ী নির্বাচিত ১০০ সদস্য নিয়ে।

এই উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো সংবিধান সংশোধন করা যাবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা আরও শক্তিশালী হবে।

তৃতীয় প্রস্তাব: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি

তৃতীয় প্রস্তাবে রয়েছে সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের এক বিস্তৃত পরিকল্পনা।
জুলাই সনদের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

  • সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি
  • বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন
  • প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করা
  • রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি
  • বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা
  • স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতায়ন করা
  • মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের সম্প্রসারণ

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ প্রস্তাবগুলো শুধু রাজনৈতিক সংস্কার নয়; এটি হচ্ছে জনগণের অধিকারের সুরক্ষা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করার রূপরেখা।”

চতুর্থ প্রস্তাব: জুলাই সনদের অন্যান্য সংস্কার বাস্তবায়ন

চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জুলাই সনদে যেসব সংস্কারমূলক ধারণা রয়েছে—সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে।
এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, সংসদের স্বচ্ছতা, দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো, স্থানীয় প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিষয়গুলো।

‘এক প্রশ্নে হ্যাঁ বা না ভোট’—ব্যাখ্যা দিলেন ইউনূস

প্রফেসর ইউনূস বলেন, “গণভোটের চারটি প্রস্তাবই একটি মাত্র প্রশ্নে সংযুক্ত থাকবে। ভোটারদের শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ‘হ্যাঁ’ বলেন, তবে আমরা একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করব, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধানের সংশোধনী কাজ করবেন।”

এই পরিষদ ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করবে এবং পরে সংসদে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও উচ্চকক্ষ গঠনের পরিকল্পনা

প্রধান উপদেষ্টা জানান, সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।
এই উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

তিনি বলেন, “এটি হবে বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় নতুন ইতিহাস। আমরা জনগণের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাই। জনগণই নির্ধারণ করবে তাদের সংবিধান কেমন হবে।”

জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হবে সংবিধানে

ভাষণে তিনি আরও জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এই সনদে সংবিধান সংস্কার, ক্ষমতার ভারসাম্য, মানবাধিকার, নির্বাচন প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং নাগরিক স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ কাঠামো বর্ণনা করা হয়েছে।

“এটি কেবল রাজনৈতিক সংস্কার নয়, এটি একটি সামাজিক চুক্তি—জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার নতুন সম্পর্কের সূচনা,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই গণভোট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বড় পদক্ষেপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহানা রহমান বলেন,
“গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে দেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে। তবে এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি।”

অন্যদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল হালিম বলেন,
“তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ও উচ্চকক্ষ গঠন—দুটিই প্রশাসনিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে। তবে এ প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক কৌশলের বলি না হয়, সেটি দেখার দায়িত্বও আমাদের সবার।”

জনগণের প্রত্যাশা ও আগ্রহ

গণভোটের ঘোষণা আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
অনেকে একে “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের নতুন সূচনা” হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে।
রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নাফিজা রহমান বলেন, “আমরা চাই রাজনীতি হোক স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনগণকেন্দ্রিক। এই গণভোট সেই সুযোগ এনে দিতে পারে।”

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণের শেষে বলেন,
“এই গণভোট আমাদের নতুন ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করবে। আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্ম কেমন রাষ্ট্রে বাস করবে। আমি বিশ্বাস করি, জনগণ গণতন্ত্র, ন্যায় ও সুশাসনের পক্ষে রায় দেবে।”

বাংলাদেশের ইতিহাসে গণভোট সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে—১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালের মতো। তবে এবারকার গণভোট হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে জনগণ সরাসরি নির্ধারণ করবে সংবিধানের কাঠামো ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা।

২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি ভোট নয়—এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সংবিধান এবং শাসন কাঠামোর এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের সূচনা।

MAH – 13788 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button