সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এক অনন্য ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শনী, যার মূল থিম ছিল— ফ্যাসিবাদী শাসন, গুম, খুন, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র।
গত বুধবার (১২ নভেম্বর ২০২৫) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর ১০টি ভিন্ন স্থানে একযোগে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি স্থানে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করেছে, জনগণ এখন ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আরও সচেতন ও আগ্রহী।
এই আয়োজনে প্রদর্শিত ডকুমেন্টারিগুলো শুধু চলচ্চিত্র নয়— এগুলো একেকটি নথিপত্র, একেকটি স্মৃতি, একেকটি ইতিহাস। এগুলোতে উঠে এসেছে সেইসব মানুষের মুখ, যাদের জীবনের মূল্য দিতে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য।
যে ডকুমেন্টারিগুলো প্রদর্শিত হয়
প্রদর্শিত ডকুমেন্টারিগুলোর মধ্যে ছিল:
- ‘জুলাই বীরগাথা (চোখ হারানো মাহবুব)’ – জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাহসী তরুণ মাহবুবের সংগ্রামের কাহিনি।
- ‘জুলাই বিষাদ সিন্ধু (শহীদ হৃদয় তরুয়া ও শহীদ আবু ইসহাক)’ – যারা জীবন দিয়ে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদে, তাদের স্মৃতিকে সম্মান জানানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
- ‘ইউ ফেইলড টু কিল আবরার ফাহাদ’ – বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়ার এক তীব্র প্রতিবেদন।
- ‘থার্টি সিক্স আওয়ারস অফ বিট্রেয়াল’ – একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার ৩৬ ঘণ্টার নথি।
- ‘গণলুটতন্ত্রী আওয়ামী সরকার’ – দেশের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার লুটপাট, দুর্নীতি ও দমননীতির চিত্র।
- ‘আয়নাঘর ফাইলস’ সিরিজ – হুমাম কাদের, ব্যারিস্টার আরমান, সুখরঞ্জন বালি এবং সাজেদুল ইসলাম সুমনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে চারটি পৃথক পর্ব।
- ‘ট্রায়াল অফ জুলাই ম্যাসাকার’ – জুলাই মাসে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচার ও বিচারের দাবি নিয়ে নির্মিত।
- ‘এমনকি লাশেরাও পায়নি রেহাই’ – গুম ও খুনের পর নিখোঁজদের পরিবারের অসহায় আর্তনাদ।
- ‘সাদা জুব্বা: লাল রক্ত’ – ধর্মীয় পোশাকের আড়ালে লুকানো সহিংসতা ও মানবতার হত্যার চিত্র।
- ‘উইল ইউ এভার স্লিপ, মা?’ – এক মায়ের নির্ঘুম রাত ও হারানো সন্তানের ব্যথা নিয়ে নির্মিত আবেগময় ডকুমেন্টারি।
প্রতিটি চলচ্চিত্র দর্শকদের নাড়া দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। দর্শকদের অনেকে বলেছেন— এ যেন চলচ্চিত্র নয়, একেকটি জীবন্ত দলিল।
রাজধানীর ১০টি স্থানে একযোগে আয়োজন
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই প্রদর্শনী আয়োজন করা হয় রাজধানীর ১০টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।
সেসব স্থান হলো—
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, যাত্রাবাড়ী পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, বাহাদুর শাহ পার্ক, মিরপুর পল্লবী (হারুন মোল্লার মাঠ), উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তমঞ্চ, উত্তরা জমজম টাওয়ার, মোহাম্মদপুর টাউন হল মাঠ, হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটার এবং হাতিরঝিলের রামপুরা প্রান্ত।
প্রতিটি স্থানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সঙ্গে ছিল সংগীত পরিবেশনা ‘জুলাইয়ে গান’। স্থানীয় শিল্পীরা দেশপ্রেম, গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে লেখা গান পরিবেশন করেন। অনেক দর্শক তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছেন প্রতিবাদের গান।
দর্শকদের প্রতিক্রিয়া
প্রদর্শনীগুলোর প্রতিটি স্থানেই ছিল দর্শকদের ব্যাপক উপস্থিতি। অনেকেই ছোট সন্তান ও পরিবার নিয়ে এসেছিলেন। দর্শকদের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
টিএসসিতে চলচ্চিত্র দেখতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আফরিন সুলতানা বলেন,
“আমরা ইতিহাস বইয়ে অনেক কিছু পড়ি, কিন্তু এই ডকুমেন্টারিগুলো দেখে মনে হলো— আমাদের চোখের সামনে বাস্তব ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠেছে।”
মোহাম্মদপুর টাউন হলে এক দর্শক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. নাসির উদ্দিন জানান,
“এই ফিল্মগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই কখনো শেষ হয় না।”
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন,
“সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজের প্রতিবিম্ব। তাই আমরা চাই— সংস্কৃতির শক্তি দিয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত হোক।”
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক আরও যোগ করেন,
“ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র হলো বাস্তবতার আয়না। আমরা চাই— এই আয়নায় মানুষ সত্য দেখুক, ন্যায়বিচার খুঁজে পাক।”
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ, গুম, খুন ও নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিরোধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় দমননীতির অভিযোগ উঠে এসেছে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিখোঁজ হওয়া নাগরিকদের সংখ্যা বেড়েছে— এমন তথ্য জানিয়েছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা।
এই প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া ডকুমেন্টারিগুলো শুধু শিল্পকর্ম নয়, বরং মানবাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিক অংশ।
‘জুলাই বীরগাথা’ ও ‘ট্রায়াল অফ জুলাই ম্যাসাকার’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো সেই প্রতিবাদেরই প্রতিফলন।
মানবাধিকার কর্মীদের মতামত
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর একজন প্রতিনিধি বলেন,
“চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজে যে বার্তা পৌঁছানো যায়, তা অনেক সময় বক্তৃতা বা প্রতিবাদে সম্ভব হয় না। এই ডকুমেন্টারিগুলো মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখাবে— কেন একজন মানুষকে শুধু মতভিন্নতার কারণে গুম করা হয়?”
অন্যদিকে, এক বিশ্লেষক মনে করেন, এই ধরনের প্রদর্শনী সরকার ও প্রশাসনকে মানবাধিকারের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হতে বাধ্য করবে।
ডকুমেন্টারির শক্তি ও সামাজিক প্রভাব
ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয়; এটি পরিবর্তনের হাতিয়ার।
বিশ্বজুড়ে ‘দ্য কিলিং ফিল্ডস’, ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ কিংবা ‘দ্য অ্যাক্ট অব কিলিং’-এর মতো চলচ্চিত্র যেমন সমাজে আলোড়ন তুলেছে, তেমনি বাংলাদেশেও এখন সেই ধারায় নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
‘উইল ইউ এভার স্লিপ, মা?’ চলচ্চিত্রটি একজন মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তি তুলে ধরেছে— যা দর্শকদের কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে এবং প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও আয়োজন করা হবে অনুরূপ প্রদর্শনী।
শিল্পকলা একাডেমি ইতিমধ্যে পরিকল্পনা করেছে— আগামী মাসে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজন করা হবে।
একটি রাষ্ট্র তখনই পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়, যখন তার জনগণ সত্য জানতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে এবং ভয়ের বাইরে থেকে মত প্রকাশ করতে পারে।
এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীগুলো সেই সাহসের প্রতীক।
দর্শকদের চোখের জল, করতালি ও দীর্ঘশ্বাস যেন প্রমাণ করে— মানুষ এখন আর নীরব নয়।
তারা দেখতে চায় সত্য, শুনতে চায় নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর, এবং জানতে চায়— কবে শেষ হবে এই দমননীতির অন্ধকার অধ্যায়।
এই প্রদর্শনী হয়তো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, কিন্তু এটি ইতিহাসের সাক্ষ্য, ন্যায়বিচারের আহ্বান, এবং মানবতার জন্য এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা।
MAH – 13786 I Signalbd.com



