বাংলাদেশ

আজহারীর বই নকল, ডিবিকে তদন্ত করতে আদালতের স্ব-প্রণোদিত আদেশ

Advertisement

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা ও গবেষক মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী রচিত আলোচিত গ্রন্থ ‘এক নজরে কুরআন’ নকল ও পাইরেটেড করে বাজারে বিক্রির অভিযোগে ঢাকার একটি আদালত স্বপ্রণোদিতভাবে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই আদেশের মাধ্যমে আদালত কপিরাইট সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করলো বলে মনে করছেন আইনি বিশেষজ্ঞরা।

ঘটনার পটভূমি

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান “চুরি বিদ্যা”-তে অভিযোগ তোলা হয় যে, জনপ্রিয় ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মিজানুর রহমান আজহারী-এর বই ‘এক নজরে কুরআন’ অনুমতি ছাড়া নকল করে প্রকাশ ও বিক্রি করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়—বইটির পাইরেটেড কপি রাজধানীর বাইতুল মোকাররম, পুরানা পল্টন, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও নকল কপির বিক্রি চলছে বলে অভিযোগ উঠে।

অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা সরেজমিন তদন্ত করে কয়েকটি দোকান থেকে পাইরেটেড কপি সংগ্রহ করেন। অভিযোগে বলা হয়, এসব নকল কপির প্রকাশনায় বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জড়িত। তবে টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ অস্বীকার করে।

আদালতের আদেশ

মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর ২০২৫) ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন আদালতের এই গুরুত্বপূর্ণ আদেশ প্রদান করেন।
আদালত নির্দেশ দিয়েছেন—ডিবি পুলিশকে (গোয়েন্দা শাখা) বিষয়টি তদন্ত করে আগামী ১১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

আদালতের আদেশে বলা হয়,

“মাওলানা ড. মিজানুর রহমান আজহারী রচিত বই ‘এক নজরে কুরআন’-এর নকল ও পাইরেটেড সংস্করণ প্রকাশ ও বিক্রয় করা দেশের প্রচলিত কপিরাইট আইন অনুযায়ী একটি ফৌজদারী অপরাধ। এ অপরাধ দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত এবং তদন্ত সাপেক্ষে বিচারযোগ্য।”

বইটি কেন এত জনপ্রিয়

‘এক নজরে কুরআন’ বইটি বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রবাসী মুসলমানদের মাঝেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বইটিতে কুরআনের মূল বিষয়বস্তু ও প্রতিটি সূরার সারমর্ম সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যাতে সাধারণ পাঠকও আল্লাহর বাণীর মূল বার্তা অনুধাবন করতে পারেন।

প্রকাশের পর থেকে বইটির কয়েকটি সংস্করণ বের হয় এবং অনলাইন ও অফলাইনে লাখো কপি বিক্রি হয়েছে। ইসলামপ্রেমী পাঠকদের কাছে এটি একটি নির্ভরযোগ্য ও শিক্ষণীয় গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাই বইটির পাইরেটেড সংস্করণ বাজারে পাওয়া গেলে তা লেখকসহ পাঠকদের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

ডিবি পুলিশের দায়িত্ব ও তদন্ত প্রক্রিয়া

আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর ডিবি পুলিশ (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখা) আইন অনুযায়ী তদন্ত শুরু করবে।
তদন্তে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, মুদ্রণ কেন্দ্র, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, অনলাইন বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম এবং সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল মার্কেটগুলোতে অনুসন্ধান চালানো হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তদন্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের বই বাজারে পাইরেসি চক্রের কার্যক্রম উন্মোচিত হতে পারে।
কপিরাইট আইনের ২০০০ সালের সংশোধিত সংস্করণ অনুযায়ী, কোনো লেখকের অনুমতি ছাড়া তার রচনার নকল বা পুনর্মুদ্রণ করলে জরিমানা ও কারাদণ্ড হতে পারে।

আইনি বিশ্লেষণ

আইনজীবীরা মনে করেন, আদালতের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতে কপিরাইট সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।
বিশেষ করে ধর্মীয় বইয়ের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে পাইরেসি কেবল আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং পাঠকদের বিভ্রান্ত করার ঝুঁকিও তৈরি করে।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির এক সদস্য বলেন—

“কোনো বই নকল করা বা অনুমতি ছাড়া বিক্রি করা কেবল নৈতিক অপরাধ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালতের এমন স্বপ্রণোদিত পদক্ষেপ ভবিষ্যতে এমন অপরাধ রোধে সহায়ক হবে।”

আজহারীর প্রতিক্রিয়া

যদিও এই বিষয়ে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি, তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায় যে, বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত আছেন এবং আইনি পদক্ষেপের প্রতি সম্মান দেখাচ্ছেন।

আজহারী বরাবরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কপিরাইট ও মৌলিক কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থান নিয়েছেন।
তিনি পূর্বেও বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন—

“ইসলামিক জ্ঞান ও গবেষণা সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত, তবে কোনো লেখকের পরিশ্রম অন্য কেউ নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া ইসলাম ও মানবতার পরিপন্থী।”

পাইরেসি: একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা

বাংলাদেশে বই পাইরেসি নতুন নয়।
প্রায় প্রতিটি জনপ্রিয় লেখকের বইই প্রকাশের পর কিছু দিনের মধ্যেই নকল আকারে বাজারে দেখা যায়।
এতে লেখক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি আসল প্রকাশকরাও অর্থনৈতিকভাবে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাইরেটেড বই প্রকাশে কয়েকটি বড় চক্র কাজ করছে যারা কম খরচে নিম্নমানের কাগজে বই ছেপে বিক্রি করে।
এই চক্রের কারণে মূল বইয়ের বিক্রি কমে যায়, অথচ পাঠকরা বুঝতেই পারেন না যে তারা নকল বই কিনছেন।

অনলাইন বাজারেও নকল বই

বর্তমানে ফেসবুক পেজ, ই-কমার্স সাইট ও মার্কেটপ্লেসগুলোয় পাইরেটেড বইয়ের বিস্তার বেড়েছে।
বইপ্রেমীরা কম দামে বই কিনতে গিয়ে অজান্তেই নকল কপি ক্রয় করছেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও পরিষ্কার হলো—আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্রিয়তা না বাড়ালে পাইরেসি রোধ সম্ভব নয়।

কপিরাইট আইন কী বলে

বাংলাদেশের কপিরাইট আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৫) অনুযায়ী—

  • কোনো লেখকের লেখা, ছবি, গান, চিত্রকর্ম বা বই অনুমতি ছাড়া নকল বা প্রকাশ করলে তা ফৌজদারী অপরাধ।
  • এই অপরাধে সর্বোচ্চ ৪ বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
  • এমনকি অনলাইন মাধ্যমে পাইরেটেড কনটেন্ট বিক্রির ক্ষেত্রেও আইন প্রযোজ্য।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আজহারীর বই নকলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কপিরাইট আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন করে প্রশাসনিক মনোযোগ সৃষ্টি হবে।

জনপ্রিয় লেখকদের কপিরাইট সচেতনতা

বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় লেখক ইতিমধ্যে নিজেদের বইয়ে স্পষ্টভাবে লিখে দেন—“এই বইয়ের কোনো অংশ অনুমতি ছাড়া নকল, পুনর্মুদ্রণ বা অনলাইনে বিতরণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।”
তবুও বাস্তবে অনেকেই তা মানেন না।
আজহারীর বইয়ের মতো ধর্মীয় বই পাইরেটেড হওয়া বিষয়টিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।

পাঠকদের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজহারীর অনুরাগীরা আদালতের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
অনেকে মন্তব্য করেছেন—

“আজহারী হুজুরের মতো একজন আলেমের বই নকল করা মানে শুধু একজন লেখকের প্রতি অন্যায় নয়, বরং ধর্মীয় জ্ঞান বিকৃত করার সামিল।”

আদালতের এই স্বপ্রণোদিত পদক্ষেপ শুধু একটি মামলার নির্দেশ নয়, বরং বাংলাদেশের প্রকাশনা ও কপিরাইট জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—কোনোভাবেই নকল বা পাইরেটেড বই সহ্য করা হবে না।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি ডিবি পুলিশের তদন্ত যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অন্যরা এমন অপরাধে জড়াতে ভয় পাবে।

বাংলাদেশে মৌলিক রচনার প্রতি সম্মান দেখানো এবং লেখকদের অধিকার সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি।
‘এক নজরে কুরআন’ বইটি শুধু একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি হাজারো মানুষের আত্মিক উন্নয়নের হাতিয়ার।
এই বইয়ের নকল সংস্করণ প্রকাশ করা মানে সেই জ্ঞানের প্রতি অপমান।

MAH – 13751 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button