পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আবারও ঘটল এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। আজ মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সকালে শহরের কেন্দ্রস্থলে জেলা ও দায়রা আদালত ভবনের সামনে এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৫ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ইসলামাবাদ পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডন নিউজকে জানান, প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে এটি ছিল সুপরিকল্পিত আত্মঘাতী হামলা। বিস্ফোরণটি ঘটে আদালতের মূল ফটকের কাছে, যেখানে সকালবেলা বিচারপ্রার্থীদের ভিড় ছিল সবচেয়ে বেশি।
ভয়াবহ দৃশ্য আদালত চত্বরে
বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই চারপাশে ধোঁয়া আর চিৎকারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এক ব্যক্তি আদালতের প্রবেশদ্বারের কাছে নিরাপত্তা চৌকি অতিক্রম করার চেষ্টা করছিলেন। তখনই হঠাৎ প্রবল শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে, মুহূর্তের মধ্যে চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আদালত ভবনের সামনে থাকা কয়েকটি গাড়ি আগুনে জ্বলছে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে পড়ে আছে আহত মানুষ, রক্তে ভেজা মাটিতে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছেন অনেকে। পুলিশ ও উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের নিকটস্থ হাসপাতালগুলোতে পাঠায়।
আহতদের চিকিৎসা চলছে
ইসলামাবাদ ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (IIMS) ও পিমস হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের শরীরে গভীর পোড়া ও বোমার স্প্লিন্টার লেগে গুরুতর আঘাত লেগেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে রক্তের চাহিদা পূরণের জন্য সাধারণ জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এই ঘটনাকে “নৃশংস আত্মঘাতী বিস্ফোরণ” বলে অভিহিত করে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্যই করা হচ্ছে, কিন্তু আমরা নতি স্বীকার করব না।”
প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেন, “এই হামলা আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত।” তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সতর্কবার্তা
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হামলাটিকে দেশের জন্য এক “গুরুতর সতর্কবার্তা” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “দেশের অভ্যন্তরে আবারও সন্ত্রাসবাদের শিকড় শক্ত হচ্ছে। আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান আমাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়নি, বরং নতুনভাবে শুরু হয়েছে।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রেক্ষাপট
গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কিছুটা কমলেও, ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ফের বাড়ছে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারের পর তালেবান ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) নতুন করে সংগঠিত হয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পুলিশ সদর দফতরে বোমা হামলায় ৮০ জন নিহত হয়েছিলেন। এরপর মার্চ মাসে বেলুচিস্তানে সামরিক কনভয়ে হামলায় নিহত হন আরও ১২ সেনা সদস্য।
ইসলামাবাদে এই সাম্প্রতিক বিস্ফোরণটি দেশটির কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক এলাকাতেই ঘটায় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এটি বড় ধাক্কা।
প্রাথমিক তদন্ত ও সন্দেহভাজন গোষ্ঠী
ঘটনার পরপরই ইসলামাবাদ পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয় দল ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাটি করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) বা তাদের সহযোগী কোনো গোষ্ঠী। যদিও এখনো কোনো সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “বিস্ফোরকের ধরন এবং আত্মঘাতী হামলার পদ্ধতি দেখে মনে হচ্ছে এটি অভিজ্ঞ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাজ। তারা আদালতকে লক্ষ্য করেছে, যাতে সরকারের ওপর জনমনে ভয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।”
আদালতের বিচারক ও আইনজীবীরা আতঙ্কে
বিস্ফোরণের সময় আদালতের ভেতরে চলছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আদালতের এক কর্মচারী জানান, “বিস্ফোরণের শব্দে ভবন কেঁপে ওঠে, সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকে। কয়েকজন আইনজীবী আহত হয়েছেন।”
ইসলামাবাদ বার অ্যাসোসিয়েশন এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানিয়েছে।
নিরাপত্তা জোরদার ও তদন্ত শুরু
বিস্ফোরণের পরপরই ইসলামাবাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, এবং বিদেশি দূতাবাস এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন এক মোটরসাইকেলচালককেও আটক করা হয়েছে, যিনি বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে ঘটনাস্থলে ঘোরাফেরা করছিলেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবসময় পাশে থাকবে। নিরপরাধ মানুষের ওপর এমন বর্বর হামলার কোনো ন্যায্যতা নেই।”
ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকেও পৃথকভাবে সমবেদনা জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের লড়াইয়ে সংহতি প্রকাশ করছি।”
পাকিস্তানের জনগণের ভয় ও ক্ষোভ
ইসলামাবাদের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শহরে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেশটির নাগরিকরা সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আমরা ভাবতাম রাজধানী নিরাপদ, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোথাও নিরাপত্তা নেই।”
আবারও প্রশ্নে পাকিস্তানের নিরাপত্তা
ইসলামাবাদে আদালতের সামনে এই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ শুধু ১২টি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং পুরো পাকিস্তানকে আবারও মনে করিয়ে দিল—সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহ ছায়া এখনও ঘনিয়ে আছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি, সীমান্তে উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান এখন এক কঠিন সময় পার করছে। সরকার বলছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এই ধারাবাহিক সহিংসতা কবে থামবে, আর সাধারণ মানুষ কবে পাবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা?
MAH – 13749 I Signalbd.com



