রাজনীতি

জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়

Advertisement

রাজধানীর পল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন— “জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি ছাড়া দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না।”
তিনি বলেন, “দেশের জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। জুলাই বিপ্লবের যে সনদ জাতির আশা জাগিয়েছে, তার আইনি স্বীকৃতি ছাড়া কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না।”

রাজধানীতে আটদলীয় সমাবেশ: পরিবর্তনের ডাক

মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)—এই আটটি দলের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এই বড় রাজনৈতিক সমাবেশ।

“জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, সাংবিধানিক আদেশ জারি, নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজন এবং নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা”—এই পাঁচ দফা দাবিকে সামনে রেখে তারা এই কর্মসূচি পালন করে।

‘জুলাই বিপ্লব’ ও তার সনদ: জনগণের প্রত্যাশা

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “জুলাই বিপ্লব কোনো দলীয় আন্দোলন নয়; এটি জনগণের আন্দোলন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পরিবর্তনের। সেই পরিবর্তনের প্রতীকই জুলাই সনদ। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার সেই সনদের আইনি স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ জনগণ সেই সনদকে তাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশিকা হিসেবে দেখছে।”

তিনি আরো বলেন, “জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আচরণে দেখা যাচ্ছে তারা জনগণের সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায়।”

‘আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচন নয়’—জামায়াত আমিরের সাফ বার্তা

জামায়াত আমির তার বক্তব্যে বলেন,
“আইনি স্বীকৃতি ছাড়া নির্বাচনের কোনো অর্থ নেই। যদি সরকার সত্যিই জনগণের প্রতিনিধি হতে চায়, তাহলে আগে জুলাই সনদকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এরপরই গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিতে হবে।”

তিনি প্রশ্ন রাখেন,
“যদি গণভোটের বিষয়ে সকল দল একমত হয়, তাহলে তারিখ নিয়ে এই টালবাহানা কেন? জনগণ এখন আর ধোঁকা খাবে না।”

গণভোটের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলসমূহ

এই সমাবেশের মূল দাবি ছিল—আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত করতে হবে, যাতে জনগণ নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে তারা কেমন সরকার চায়।
আয়োজক দলের নেতারা বলেন, “গণভোট ছাড়া নির্বাচন হলে তা হবে প্রহসন। জনগণ সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না।”

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি তার বক্তব্যে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন চাই। কিন্তু জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে নামব।”

‘জুলাই সনদ’ কী, কেন এত আলোচনায়?

২০২৫ সালের জুলাই মাসে দেশজুড়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়, তা-ই বর্তমানে পরিচিত ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে।
এই আন্দোলনের ফলে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারণা সামনে আসে—‘জুলাই জাতীয় সনদ’, যেখানে বলা হয়:

  1. জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে।
  2. নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে গঠন করতে হবে।
  3. সংবিধান সংশোধন করে জনগণের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
  4. বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে।
  5. অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে।

এই সনদটি তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করলেও সরকার এখনো পর্যন্ত এর আইনি ভিত্তি দিতে অনিচ্ছুক।
এ কারণেই বিরোধী দলগুলো এখন “জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচন নয়”—এই স্লোগানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

সমাবেশে জনতার ঢল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

মঙ্গলবারের সমাবেশে রাজধানীর পল্টন এলাকা ছিল জনসমুদ্রে পরিণত। সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন।

পল্টন, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, আরামবাগ এবং মতিঝিল এলাকায় যান চলাচল কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা মোতায়েন ছিল।

কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষ বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে জানায় পুলিশ। তবে কিছু এলাকায় সাময়িক উত্তেজনা দেখা দেয়, যা পরে নিয়ন্ত্রণে আসে।

আটদলীয় জোটের পাঁচ দফা দাবি

সমাবেশ শেষে আয়োজক দলগুলো তাদের পাঁচ দফা দাবি পুনরায় ঘোষণা করে—

  1. জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে।
  2. নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।
  3. নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
  4. রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
  5. নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে সর্বদলীয় আলোচনা আয়োজন করতে হবে।

বক্তব্যে সরকারের সমালোচনা

ডা. শফিকুর রহমান বলেন,
“সরকার জনগণের রায়ের ভয় পায় বলেই গণভোট থেকে পালাচ্ছে। তারা জানে, যদি জনগণ ভোট দিতে পারে, তাহলে তাদের আর ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না।”

তিনি আরও বলেন,
“আমরা সংঘাত চাই না, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি সরকার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়, তবে জনগণ রাজপথেই তাদের জবাব দেবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “জুলাই সনদ এখন দেশের রাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।”
তাদের মতে, যদি সরকার এই সনদকে আইনি স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন,
“বিরোধী দলগুলো এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। তারা জানে, জনগণ পরিবর্তন চায়। যদি সরকার জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।”

সরকারের অবস্থান

সরকারি সূত্র বলছে, “জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব, এর কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই।”
তারা মনে করে, “দেশের বর্তমান সংবিধানই যথেষ্ট শক্তিশালী, তাই নতুন কোনো সনদের প্রয়োজন নেই।”

তবে রাজনৈতিক মহলে অনেকে বলছেন, “যদি জনগণের বড় অংশ জুলাই সনদের পক্ষে থাকে, তাহলে সেটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”

পরিবর্তনের প্রত্যাশায় দেশ

সমাবেশ শেষে জামায়াত আমির বলেন,
“আমরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালিয়ে যাব। জনগণের দাবি যদি অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে দেশব্যাপী আরও বড় কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।”

রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নভেম্বর মাসেই গণভোটের বিষয়টি কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হতে পারে।
দেশবাসী এখন অপেক্ষায়—সরকার কি জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি দেবে, নাকি আবারও একপাক্ষিক নির্বাচনের পথে যাবে?

MAH – 13748 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button