ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে আবারও মুসলিম বিরোধী অভিযানে নামল হেমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী সরকার। এবার রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলায় ৫৮০ মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের দাবি, এগুলো “বনের জমিতে অবৈধ দখল” ছিল। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এটি আসলে মুসলিমদের টার্গেট করে পরিকল্পিত উচ্ছেদ অভিযান।
বুলডোজারের নিচে ভেঙে পড়ল শত শত স্বপ্ন
মুসলিম মিররের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার ভোর থেকে শুরু হওয়া অভিযানে বন বিভাগ ও পুলিশের এক হাজারের বেশি সদস্য অংশ নেন। ভারী যন্ত্রপাতি ও বুলডোজার ব্যবহার করে টানা দুই দিন ধরে দহিকাটা সংরক্ষিত বনের পাশে গড়ে ওঠা মুসলিম পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, মোট ১,১৪৩ বিঘা (প্রায় ১৫৩ হেক্টর) জমিতে এই অভিযান চালানো হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, নারী ও শিশুরা কাঁদছে, পুরুষরা অসহায়ভাবে ভাঙা ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে নিজেদের মালপত্র বাঁচাতে চেষ্টা করলেও বুলডোজারের তাণ্ডবে কিছুই রক্ষা করতে পারেননি।
সরকারের দাবি: “অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা, যিনি বিজেপির একজন প্রভাবশালী নেতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (টুইটার)-এ লেখেন,
“আমরা আমাদের বনভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গোয়ালপাড়ার দহিকাটা বনাঞ্চল থেকে অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করা হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বনের জমিতে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছিল কিছু পরিবার। সেই কারণেই এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে একই ধরনের অভিযানে প্রায় ৯০০ হেক্টর জমি উদ্ধার করা হয়েছিল।
বাসিন্দাদের অভিযোগ: মুসলিমদের লক্ষ্য করেই অভিযান
কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বলছে, এই অভিযানের নামে মুসলিমদের টার্গেট করা হয়েছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান,
“আমরা এখানে দশকের পর দশক ধরে বাস করছি। সরকারি নথিতেও আমাদের নাম আছে। তবুও শুধু মুসলিম বলেই আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।”
অনেকের অভিযোগ, প্রশাসন আগে কোনো নোটিশ দেয়নি। তারা শুধু সকালে এসে ঘরবাড়ি ভাঙতে শুরু করে। নারী ও শিশুরা কাঁদলেও কেউ কর্ণপাত করেনি।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে ঘটনাটির নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, এই ধরনের অভিযান ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন: নির্বাচনী রাজনীতির কৌশল
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের অভিযান আসলে আসামের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
২০২৬ সালে আসামের বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাংক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুবীর শর্মা বলেন,
“যখনই নির্বাচন আসে, তখনই বিজেপি মুসলিমদের টার্গেট করে কোনো না কোনো ইস্যু তৈরি করে। বনভূমি, নাগরিকত্ব, বা দখলদারিত্ব—সবকিছুই রাজনৈতিক হাতিয়ার।”
আসামের মুসলিম জনসংখ্যা ও প্রেক্ষাপট
আসাম রাজ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশের বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রাজ্যের ইতিহাসে মুসলিমরা শত শত বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে অভিবাসন, এনআরসি (NRC), ও নাগরিকত্ব আইন (CAA) নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি মুসলিমদের অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
২০১৯ সালের নাগরিকপঞ্জি (NRC) প্রকাশের পর প্রায় ১৯ লাখ মানুষকে “অবৈধ নাগরিক” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, যার বড় অংশই মুসলিম। এরপর থেকেই আসামে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও সামাজিক বৈষম্য বেড়ে গেছে।
বুলডোজার রাজনীতি: ভারতের নতুন বাস্তবতা
ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “বুলডোজার রাজনীতি” শব্দটি বিশেষভাবে আলোচিত। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, এবং এখন আসাম—সব জায়গায়ই বিজেপি সরকার মুসলিমদের ঘরবাড়ি ধ্বংসের এই কৌশল ব্যবহার করছে।
যদিও সরকার দাবি করে এটি “আইনি উচ্ছেদ”, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে টার্গেট করা হচ্ছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছে, বিনা নোটিশে কোনো ঘরবাড়ি ভাঙা যাবে না।
কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশ অমান্য করেই একের পর এক অভিযান চলছে।
মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই উচ্ছেদ অভিযানের ফলে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।
শীতের শুরুতে তাঁবুতে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (UNHRC) জানিয়েছে,
“ধর্মের কারণে কোনো সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ভারত সরকারের উচিত এসব ঘটনার স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা।”
বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিক সমাজও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #AssamBulldozerPolitics, #StopMuslimEviction হ্যাশট্যাগে চলছে প্রতিবাদ।
বঞ্চনা ও নিপীড়নের দীর্ঘ ইতিহাস
আসামের মুসলিম সম্প্রদায় বহুদিন ধরে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে আসছে।
১৯৮৩ সালের নেলি গণহত্যায় হাজার হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল, কিন্তু আজও সেই ঘটনার বিচার হয়নি।
বর্তমান সরকার সেই পুরনো ভয়কে আবারও কাজে লাগাচ্ছে—অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
আসামের মুসলিম কৃষক সংগঠন আল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AAMSU) বলেছে,
“সরকার মুসলিমদের দখলদার বলছে, অথচ এই পরিবারগুলো প্রজন্ম ধরে কর দিচ্ছে, ভোট দিচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ বর্ণবাদী আচরণ।”
সামাজিক শান্তির আহ্বান
রাজ্যের কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী ও বুদ্ধিজীবী এই ঘটনার পর সরকারের কাছে তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও ন্যায্য তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
তারা বলেন,
“বন সংরক্ষণ অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তার নামে মানুষের জীবন ধ্বংস করা যায় না।”
আসামের দহিকাটায় ৫৮০ মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙার এই ঘটনাটি শুধু একটি স্থানীয় প্রশাসনিক অভিযান নয়—এটি ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রতিচ্ছবি।
ধর্ম, জাতি ও পরিচয়ের ভিত্তিতে তৈরি বিভাজনের রাজনীতি এখন মানুষের জীবনের ওপর সরাসরি আঘাত করছে।
একজন গৃহহারা বৃদ্ধা বলেছিলেন,
“আমরা শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই। মুসলমান বলেই কি আমাদের থাকার অধিকার নেই?”
এই প্রশ্নই আজ আসামের মুসলিমদের মুখে মুখে ঘুরছে—একটি প্রশ্ন, যার উত্তর এখনও কেউ দেয়নি।
MAH – 13734 I Signalbd.com



