ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় গভীর রাতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাস সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই ঘটনায় বাসচালক জুলহাস উদ্দিন (৩৫) আগুনে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, এটি একটি পরিকল্পিত নাশকতা বা প্রতিশোধমূলক অগ্নিসংযোগের ঘটনা হতে পারে।
ঘটনাটি ঘটে সোমবার রাত প্রায় ৩টা ১৫ মিনিটে উপজেলার ভালুকজান এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে। গভীর রাতে হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তেই বাসটি পুড়ে যায়। স্থানীয়রা আগুন দেখে ছুটে এলেও ততক্ষণে চালক জুলহাসের জীবন নিভে যায় আগুনের তাপে।
নিহতের পরিচয় ও পারিবারিক তথ্য
নিহত জুলহাস উদ্দিন উপজেলার কৈয়ারচালা গ্রামের বাসিন্দা সাজু মিয়ার ছেলে। বয়স মাত্র ৩৫। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আলম এশিয়া পরিবহনে চালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জুলহাস। তাঁর অকাল মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে নিদারুণ শোক।
জুলহাসের স্ত্রী শারমিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,
“রাতেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সকালে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কে জানত, এমন ভয়ানক খবর শুনব! আমার ছোট দুই সন্তান এখন কাকে ‘বাবা’ বলে ডাকবে?”
ঘটনাস্থলে পুলিশের তদন্ত
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকনুজ্জামান বলেন,
“প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা বাসটিতে আগুন দেয়। বাসটি তখন গ্যারেজে ছিল না, রাস্তার পাশে পার্ক করা ছিল। আগুন লাগার পর চালক জুলহাস বের হতে পারেননি এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান।”
তিনি আরও জানান,
“ঘটনার পরই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বাসটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। আমরা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা উদ্ঘাটনে তদন্ত চলছে।”
ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য
ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন,
“রাত ৩টা ২৫ মিনিটে খবর পেয়ে আমরা ফুলবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট পাঠাই। প্রায় ৪০ মিনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, বাসটির ধাতব অংশ পর্যন্ত বিকৃত হয়ে গেছে। আমরা ধারণা করছি, পেট্রোল বা দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিল।”
স্থানীয়দের বর্ণনা
ভালুকজান এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন,
“রাত তখন প্রায় তিনটার বেশি। হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো শব্দ শুনে বাইরে বের হই। দেখি বাসে আগুন জ্বলছে। আগুন এত দ্রুত ছড়ায় যে কেউ কাছে যেতেও পারছিল না। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।”
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নাজমুল হোসেন বলেন,
“আগে শুনেছিলাম, এলাকায় কিছুদিন ধরে রাতের বেলায় অচেনা মানুষ ঘুরছে। হয়তো তারাই এর সঙ্গে জড়িত।”
নাশকতার আশঙ্কা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাতের বেলায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিরোধের সময় এমন নাশকতামূলক ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে, এই ঘটনাটিও হয়তো রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক অগ্নিসংযোগের অংশ হতে পারে।
একজন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা চলছে। সম্প্রতি কয়েকটি স্থানে পরিবহন লক্ষ্য করে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”
পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিক্রিয়া
ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের বলেন,
“আমরা বারবার প্রশাসনকে বলেছি, রাতে মহাসড়কে পার্ক করা গাড়িগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল। একজন নিরীহ চালকের প্রাণহানি হয়েছে—এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হচ্ছে, আমরা শান্ত হব না। প্রয়োজনে ধর্মঘট ডাকার চিন্তাও করছি।”
নিহতের পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা
জুলহাস উদ্দিনের মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোক ও হতাশা। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী, দুই ছোট সন্তান এবং বৃদ্ধ মা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন,
“জুলহাস খুব পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ ছিলেন। সারা দিন পরিশ্রম করে যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চালাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারটি এখন সম্পূর্ণ অসহায়।”
প্রশাসনের উদ্যোগ ও তদন্তের অগ্রগতি
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক নাহিদা পারভীন জানান,
“এই ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিহত চালকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“এমন অমানবিক ঘটনা বরদাস্ত করা হবে না। যারা এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
দেশজুড়ে অগ্নিসংযোগের বাড়তি প্রবণতা
বিশ্লেষকদের মতে, গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ২০টির বেশি বাস, ট্রাক, পণ্যবাহী গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় পার্ক করা যানবাহনগুলোই লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
“২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ২৬টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৭টি ঘটনায় চালক বা সহকারী আহত বা নিহত হন।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা সাধারণ অপরাধ নয়, বরং পরিবহন খাতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা।
স্থানীয়দের দাবি: নিরাপত্তা বাড়াতে হবে
স্থানীয়রা বলছেন, মহাসড়কের পাশে অনেক পরিবহনের গাড়ি রাতে পার্ক করে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
ভালুকজান এলাকার চা দোকানদার সোলেমান মিয়া বলেন,
“এখানে রাতে পুলিশ টহল কম। আগের মতো এখন কেউ পাহারাও দেয় না। তাই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।”
তিনি আরও বলেন,
“প্রশাসনের উচিত রাতের বেলায় মহাসড়কের পাশে সিসি ক্যামেরা বসানো, যাতে অপরাধীরা ধরা পড়ে।”
পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে কয়েকশ শ্রমিক বিক্ষোভ করেন। তারা দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেন।
বিক্ষোভকারীরা বলেন,
“একজন চালকের জীবন আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন আমরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামি, অথচ নিরাপত্তা নেই।”
একটি প্রাণহানির দায় কে নেবে?
চালক জুলহাস উদ্দিনের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং পুরো পরিবহন সমাজের বেদনার নাম।
একটি বাস, একটি আগুন—তার সঙ্গে পুড়ে গেছে একটি স্বপ্ন, একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই নৃশংস ঘটনার দায় কে নেবে?
আর কত চালককে আগুনে পুড়ে মরতে হবে, প্রশাসন জেগে উঠবে তার আগে?
MAH – 13733 I Signalbd.com



