গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে আইনের আশ্রয়ে ইন্টেল
বিশ্বখ্যাত মার্কিন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেল কর্পোরেশন তাদের সাবেক সফটওয়্যার প্রকৌশলী জিনফেং লু-এর বিরুদ্ধে গোপন তথ্য চুরির অভিযোগে মামলা করেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এই প্রকৌশলী চাকরি হারানোর আগেই ইন্টেলের সার্ভার থেকে প্রায় ১৮ হাজার গোপন নথি, যার মধ্যে কিছু ছিল ‘টপ সিক্রেট’, নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।
এই ঘটনায় প্রযুক্তি জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ইন্টেলের মতো উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে এত বড় মাত্রায় তথ্যচুরির ঘটনা বিরল।
চুরির অভিযোগ: কীভাবে ঘটল ঘটনাটি
ইন্টেলের মামলার নথি অনুযায়ী, জিনফেং লু ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেন। প্রায় এক দশক ধরে তিনি সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছিলেন।
তবে ২০২৫ সালের ৭ জুলাই তাঁকে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এর ঠিক আগে থেকেই তিনি সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।
ইন্টেলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Security Log) অনুযায়ী, লু চাকরিচ্যুতির আগে অফিসের সার্ভার থেকে ১৮,০০০ ফাইল ডাউনলোড করেন। এসব ফাইলে ইন্টেলের গোপন প্রকল্প, গবেষণা নকশা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রসেসর সংক্রান্ত তথ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল।
‘নিরাপত্তা জাল’ পেরিয়ে ডেটা ট্রান্সফার
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, লু প্রথমে তাঁর অফিসের ল্যাপটপ থেকে একটি এক্সটারনাল হার্ডড্রাইভে ফাইল কপি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইন্টেলের উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে সে সময় তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এরপর তিন দিন পর, অর্থাৎ চাকরির শেষ দিনের আগেই, তিনি আবার চেষ্টা করেন এবং এবার তিনি নেটওয়ার্ক অ্যাটাচড স্টোরেজ (NAS) ডিভাইসে ফাইলগুলো স্থানান্তর করতে সফল হন।
চাকরি ছাড়ার আগে পর্যন্ত তিনি যত বেশি সম্ভব তথ্য নিজের কাছে কপি করে নেন বলে ধারণা করছে কোম্পানিটি।
ইন্টেলের তদন্ত ও লু-এর নিখোঁজ হওয়া
ডেটা চুরির তথ্য ধরা পড়তেই ইন্টেলের নিরাপত্তা বিভাগ বিষয়টি তদন্ত শুরু করে।
প্রায় তিন মাস ধরে কোম্পানিটি লু-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়— ফোন, ইমেইল, এমনকি ডাকযোগেও যোগাযোগ করা হয়।
কিন্তু কোনোভাবেই তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি বর্তমানে নিরুদ্দেশ।
তদন্তে দেখা গেছে, চুরি হওয়া ফাইলগুলোতে ইন্টেলের সবচেয়ে সংবেদনশীল গবেষণার তথ্য ছিল, যা কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গেলে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
ইন্টেলের দাবি: ক্ষতিপূরণ ও তথ্য ফেরত
ইন্টেল আদালতের কাছে আবেদন করেছে যেন জিনফেং লু-এর কাছ থেকে সমস্ত চুরি হওয়া নথি ফেরত আনা হয় এবং কোম্পানির ক্ষতির জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়।
এছাড়া ইন্টেল আদালতের কাছে অনুরোধ করেছে, যাতে এই তথ্য কোথাও প্রকাশ বা বিক্রি না করা হয় এবং লু-এর সকল ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করা হয়।
ইন্টেলের সংকটকাল: কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রভাব
এই ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন ইন্টেল তাদের আর্থিক সংকটে ভুগছে।
গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৫ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছে খরচ কমানোর লক্ষ্যে।
অনেকেই ধারণা করছেন, জিনফেং লু-এর চাকরি হারানোও সেই ছাঁটাই প্রক্রিয়ার অংশ ছিল।
চাকরি হারানোর পর ক্ষোভ থেকেই হয়তো তিনি এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে মনে করছেন কিছু বিশ্লেষক।
তবে ইন্টেল এখন তাদের কর্মী ও প্রযুক্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করার পথে হাঁটছে।
আগেও ঘটেছে অনুরূপ ঘটনা
ইন্টেলের ইতিহাসে এটি প্রথম তথ্যচুরির ঘটনা নয়।
এর আগে এক সাবেক প্রকৌশলীকে তথ্যচুরির দায়ে দুই বছরের প্রবেশন ও ৩৪ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়েছিল।
ওই কর্মী ইন্টেলের গোপন ডেটা কপি করে পরে মাইক্রোসফটে যোগ দিয়েছিলেন।
আদালতের শুনানিতে জানা যায়, মাইক্রোসফট সেই তথ্য ব্যবহার করে ইন্টেলের সঙ্গে বাণিজ্যিক আলোচনায় সুবিধা নিয়েছিল।
এই ঘটনাগুলোর পর থেকেই ইন্টেল তাদের সাইবার সিকিউরিটি নীতি আরও কড়াকড়ি করেছে।
তবে এবারকার ঘটনা আগের তুলনায় অনেক বড় ও ভয়াবহ, কারণ এবার ‘টপ সিক্রেট’ পর্যায়ের হাজারো নথি চুরি হয়েছে।
তথ্য চুরি ও প্রযুক্তি যুদ্ধ
বিশ্ব প্রযুক্তি অঙ্গনে এখন চলছে ‘চিপ ও ডেটা যুদ্ধ’।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপানের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা সবচেয়ে তীব্র।
ইন্টেলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গবেষণা তথ্য কঠোরভাবে গোপন রাখে, কারণ একটি নতুন চিপের নকশা বা অ্যালগরিদম ফাঁস হয়ে গেলে তা প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে বিপুল বাণিজ্যিক সুবিধা এনে দিতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে ইন্টেলের এই ঘটনা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়; বরং এটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি নিরাপত্তার জন্যও এক বড় সতর্কবার্তা।
ডেটা সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ
তথ্য চুরির ঘটনা কেবল ইন্টেলেই সীমাবদ্ধ নয়।
অ্যাপল, টেসলা, স্যামসাংসহ আরও বহু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের গোপন তথ্য ফাঁসের আশঙ্কায় ক্রমেই কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই ও চিপ গবেষণা ক্ষেত্রের তথ্য এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে ডেটা সুরক্ষায় একাধিক নতুন আইন পাস হয়েছে।
তবু কোম্পানির ভেতরের কর্মী বা কনট্রাক্টরদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠেকানো এখনো সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি।
বিশ্লেষকদের মতামত
প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন,
“একজন অভ্যন্তরীণ কর্মী যখন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে তথ্য চুরি করেন, তখন সেটি কেবল প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা।”
তাঁদের মতে, ইন্টেল এখন যে মামলা করেছে, তা শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণের জন্য নয়— বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য।
বর্তমান অবস্থা
এখনও পর্যন্ত জিনফেং লু আদালতে কোনো জবাব দেননি।
তাঁর অবস্থান সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি।
ইন্টেল আদালতের আদেশে তাঁর ব্যাংক হিসাব, ইমেইল এবং ক্লাউড সার্ভার ট্র্যাক করার অনুমতি চাইছে।
এদিকে কোম্পানির মুখপাত্র জানিয়েছেন—
“ইন্টেল তাদের মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না। তথ্য চুরি বা ফাঁসের ঘটনায় জড়িত যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইন্টেলের এই মামলা শুধু একটি কর্পোরেট ঘটনা নয়, বরং এটি পুরো প্রযুক্তি শিল্পকে নড়েচড়ে বসিয়েছে।
একজন কর্মীর অসততা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের গোপন তথ্য নয়, বরং একটি দেশের প্রযুক্তিগত ভবিষ্যতকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে— এই বাস্তবতাই আবারও সামনে এনেছে এই ঘটনা।
বিশ্ব যখন আরও বেশি সংযুক্ত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে, তখন তথ্য সুরক্ষাই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইন্টেলের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি এক কঠিন শিক্ষা— “বিশ্বাস” এখন আর যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন শক্তিশালী ডেটা নিরাপত্তা সংস্কৃতি।
MAH – 13732 I Signalbd.com



