বিশ্ব

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আল–শারাকে দুইবার হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ

Advertisement

সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমদ আল–শারার ওপর অন্তত দুই দফা হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। সিরীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক তৎপরতায় সেই হামলা পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অপর একটি দেশের দুই জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, এই হত্যাচেষ্টা সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের প্রতি সরাসরি এক বড় হুমকি ছিল।

এই ঘটনার পেছনে আইএসের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশটির রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া, এবং প্রেসিডেন্ট শারার নেতৃত্বাধীন সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া। বিশেষ করে এমন সময় এই তথ্য সামনে আসে, যখন শারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক আইএস-বিরোধী জোটে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন—যা সিরিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

দুইবার হত্যাচেষ্টা, দুবারই ব্যর্থ

রয়টার্সসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে প্রেসিডেন্ট আল–শারার বিরুদ্ধে দুটি আলাদা হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করা হয়েছে। এর একটি পরিকল্পনা ছিল এক সরকারি অনুষ্ঠানে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে। তবে বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে সিরীয় কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, “রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। আইএস বা অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী এমন অপচেষ্টা চালালে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।”

শারার নেতৃত্বে নতুন সিরিয়া: আসাদ পরবর্তী যুগের সূচনা

আহমদ আল–শারা গত ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসেন, যখন তার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনী দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল–আসাদকে উৎখাত করে। ১৪ বছরের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া এখন ধীরে ধীরে নতুন পথে হাঁটছে। শারা ক্ষমতায় এসেই নিজেকে একজন মধ্যপন্থী ও সংস্কারমুখী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন।

তাঁর মূল লক্ষ্য—যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠন করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ফিরিয়ে আনা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং আইএস-বিরোধী জোটে যোগদানকে তিনি সেই প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সফর: এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত

আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে আহমদ আল–শারার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এটি হবে কোনো সিরীয় রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের এক ঐতিহাসিক অধ্যায় খুলে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

শারা আশা করছেন, এই বৈঠক সিরিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন পথ তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সিরিয়ার ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে, তাহলে দেশটির পুনর্গঠন দ্রুত এগিয়ে যাবে।

রাশিয়া–ইরান থেকে পশ্চিমা জোটে ঝুঁকছে সিরিয়া

বাশার আল–আসাদের সময় সিরিয়া ছিল রাশিয়া ও ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু আহমদ আল–শারার সরকার আসার পর দেশটির পররাষ্ট্রনীতি বড় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। শারা একদিকে মস্কো ও তেহরানের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে আরব ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আইএস-বিরোধী জোটে সিরিয়ার আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শক্তির মেরুকরণ ঘটাতে পারে।

আইএসবিরোধী অভিযান: সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার

রোববার সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানিয়েছে, দেশজুড়ে বৃহৎ আইএসবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। সরকারি গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে ৭০ জনের বেশি সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

একজন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী আইএস সরকারের স্থাপনা, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং সামরিক ঘাঁটির ওপর নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছিল। আমরা আগেই পদক্ষেপ নিয়েছি, যেন তারা বুঝতে পারে—সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এখন আরও শক্তিশালী।”

এই অভিযানকে বিশেষজ্ঞরা আইএসের প্রতি “কঠোর বার্তা” হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে এটি প্রেসিডেন্ট শারার দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন।

আইএসের পুনরুত্থানের চেষ্টা ও ধর্মীয় প্রপাগান্ডা

আসাদ সরকারের পতনের পর আইএস আবারও সিরিয়ায় প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা নতুন সরকারের পশ্চিমা ঘনিষ্ঠতাকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট শারার ধর্মীয় সহনশীলতা ও নারী অধিকার বিষয়ে সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আইএসের প্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

গত জুনে দামেস্কের একটি গির্জায় ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত হন। যদিও আইএস সরাসরি দায় স্বীকার করেনি, সরকার তাদেরকেই দায়ী করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইএস এই ধরণের হামলার মাধ্যমে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে নতুন সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন হারায়।

শারার অতীত: বিদ্রোহী কমান্ডার থেকে রাষ্ট্রপ্রধান

আহমদ আল–শারা মূলত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর ইদলিবের বাসিন্দা। তিনি একসময় ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)–এর নেতৃত্বে ছিলেন, যা আল–কায়েদার সিরীয় শাখা হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তিনি সংগঠনটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনভাবে লড়াই শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে আইএসবিরোধী এক শক্তিশালী কমান্ডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

গত বছর মাত্র ১১ দিনের ঝটিকা অভিযানে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। সেই সময় তিনি ঘোষণা দেন, “আমরা এমন এক সিরিয়া চাই যেখানে ধর্ম, জাতি ও মতভেদে বিভাজন নয়, ঐক্যই হবে ভিত্তি।” তাঁর এই বার্তাই অনেক সাধারণ সিরীয় নাগরিকের আস্থা অর্জন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা ও নতুন আশা

কয়েক মাস ধরে সিরিয়ার সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএস-বিরোধী জোটে যোগ দিলে এই সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ওয়াশিংটনের সূত্রে জানা গেছে, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের আস্থা অর্জনের অংশ, যাতে বছরের শেষ নাগাদ সিরিয়ার ওপর থাকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা যায়।

রয়টার্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো দামেস্কের একটি বিমানঘাঁটিতে স্থায়ী উপস্থিতি গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ঘাঁটির নাম প্রকাশ করা হয়নি, তবে এর মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া এখনো নানা সংকটে জর্জরিত। অবকাঠামো ধ্বংস, খাদ্য ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব দেশের পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা। প্রেসিডেন্ট শারাকে তাই একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং জঙ্গিবাদ দমন—এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পশ্চিমা সহায়তা পেলে সিরিয়া আগামী পাঁচ বছরে পুনরুদ্ধারের পথে ফিরতে পারবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন অব্যাহত স্থিতিশীলতা ও বিদেশি বিনিয়োগের নিশ্চয়তা।

সিরিয়ার জনগণের প্রত্যাশা

দীর্ঘ যুদ্ধ, নিপীড়ন ও অনিশ্চয়তার পর সিরিয়ার সাধারণ মানুষ এখন শান্তি চায়। দামেস্কের এক শিক্ষক বলেন, “আমরা যুদ্ধ নয়, কাজ চাই। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা স্কুলে যাক, বোমার শব্দে নয়, পাখির ডাকে ঘুম ভাঙুক।”

এই প্রত্যাশাই এখন আহমদ আল–শারার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুঁজি।

আইএসের হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সিরিয়ার সরকার শুধু প্রেসিডেন্টের জীবনই রক্ষা করেনি, বরং এক নতুন যুগের প্রতিশ্রুতিও বাঁচিয়ে রেখেছে। আহমদ আল–শারা এখন এমন এক সময়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যখন বিশ্ব তাকিয়ে আছে সিরিয়ার পুনর্জাগরণের দিকে। সামনে তাঁর চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক, দেশের মানুষ শান্তি ও পুনর্গঠনের আশায় তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে।

MAH – 13731 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button