পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনার প্রভাব: নতুন দ্বিধার সূচনা
পৃথিবীর মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তান। কিন্তু বর্তমানে দেশটির রাজনীতিতে নতুন করে সেনাশাসনের ছায়া পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সংবিধানে ২৭তম সংশোধনী প্রবর্তনের মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে অগ্রাধিকার এবং বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন নিয়েই রাজনৈতিক ও বিশ্লেষক মহলে তীব্র আলোচনা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যদি এই সংশোধনী কার্যকর হয়, তাহলে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়বে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব আরও বাড়বে, আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বলা হচ্ছে, দেশটি আবারও সামরিক শাসনের দিকে ধাবিত হতে পারে।
ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির: পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি
বর্তমান পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিরূপে পরিচিত ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, তিনি বিদেশ নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও গভীর প্রভাব রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে তার একান্ত বৈঠক দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য বোঝায়।
২৭তম সংশোধনী অনুযায়ী, আসিম মুনিরকে দেশের প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ তিনি তিন বাহিনীর (সেনা, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী) সর্বোচ্চ পদে বসবেন এবং আজীবন দায়মুক্ত থাকবেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরণের ক্ষমতার এককরণ পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে ভঙ্গুর করে তুলবে।
২৭তম সংশোধনী: বিতর্ক ও বৈধতা
পাকিস্তানের ইতিহাসে এটি অন্যতম বিতর্কিত সংবিধান সংশোধনী। মূলত, এটি প্রতিরক্ষা কাঠামোর ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করার আশঙ্কা তৈরি করেছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর প্রভাবকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ফলে, সেনা কর্মকর্তারা দেশের রাজনীতিতে আরও গভীরভাবে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হবেন।
দেশের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিফ ইয়াসিন মালিক (অব.) মন্তব্য করেছেন, “বিমান ও নৌবাহিনীর ওপর কর্তৃত্বপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তাকে প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্যহীনতা এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ছাড়া কিছু নয়। এই সংশোধনী প্রতিরক্ষা কাঠামোকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে একটি ব্যক্তির সুবিধার জন্য তৈরি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রেও জয়েন্ট চিফদের সীমিত ক্ষমতা থাকে। পাকিস্তানের মতো সংবিধান পরিবর্তন করে সেনা কর্মকর্তাদের আজীবন সুরক্ষা দেওয়া বেসামরিক কর্তৃত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে।”
পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য সম্ভাব্য হুমকি
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২৭তম সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত অচল হয়ে যেতে পারে। সেনাপ্রধানের বিশাল ক্ষমতার কারণে নির্বাচিত সরকার এবং বেসামরিক প্রশাসনের ওপর সেনা হস্তক্ষেপ আরও দৃঢ় হবে।
এছাড়া, সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য হারাতে পারে। এর ফলে জাতীয় নীতিনির্ধারণী, আইন প্রণয়ন, বাজেট সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, এবং বিদেশ নীতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা নিতে পারবে।
পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনার প্রভাব
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনার প্রভাব নতুন নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেশটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রায়শই সেনাশাসনের ছায়ায় পড়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আইয়ুব খান থেকে জিয়াউল হক ও পারভেজ মুশারফ পর্যন্ত সেনা কর্মকর্তারা দেশ পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন।
- আইয়ুব খান: ১৯৫৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
- জিয়াউল হক: সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আসেন।
- পারভেজ মুশারফ: ১৯৯৯ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাশাসন চালান।
এই প্রেক্ষাপট নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ভারসাম্য আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষক মত
বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দেশ। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষ করে সেনার ক্ষমতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামরিক হস্তক্ষেপ ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার এককরণ পাকিস্তানের বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
তারা আরও উল্লেখ করছেন, দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সেনাশাসনের পুনরুত্থান অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সেনার প্রভাবের বৈধতা এবং সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক হুমকি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন দ্বিধা তৈরি করেছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা একথা প্রমাণ করছে, পাকিস্তান ফের সেনাশাসনের পথে এগোচ্ছে কি না—এটি সময়ই বলবে।
রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও সাধারণ জনগণ এখন এই পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে সচেতন। পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, সংবিধান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবই এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
MAH – 13724 I Signalbd.com



