বাংলাদেশ

রাজধানীতে দুই বাসে আগুন: আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

Advertisement

রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্যে মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুরে সোমবার ভোরে দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ করেই ভিক্টর পরিবহনের দুটি বাসে আগুন ধরে যায়। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে বাসের ভেতর থেকে বাইরে। তবে সৌভাগ্যক্রমে কোনো যাত্রী বা পথচারী হতাহত হননি বলে নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।

দুটি স্থানে একযোগে আগুন

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা গেছে, আজ ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে প্রথমে খবর আসে শাহজাদপুরে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে আগুন লেগেছে। এর কিছুক্ষণ পরেই মেরুল বাড্ডা এলাকার আরেকটি বাসে আগুনের খবর আসে। ফায়ার সার্ভিসের মোট চারটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানান, “আমরা ভোরে দুটি পৃথক স্থান থেকে আগুন লাগার সংবাদ পাই। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বাসে কীভাবে আগুন লাগলো তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।”

কে দিল আগুন, কেন—রহস্য ঘনীভূত

ঘটনার পর থেকেই এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য। বাসে আগুন লাগার পেছনে কারা জড়িত, কিংবা উদ্দেশ্য কী—সে বিষয়ে এখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।

কর্তৃপক্ষের ধারণা, এটি হয়তো পরিকল্পিত নাশকতা বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত একটি ঘটনা হতে পারে। কারণ একই পরিবহনের দুটি বাসে একই সময়ে আগুন লাগা নিছক কাকতালীয় নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, “ভোরের দিকে হঠাৎ দেখি বাইরে হৈচৈ হচ্ছে। বের হয়ে দেখি ভিক্টর পরিবহনের বাসে আগুন জ্বলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে। তবে কে বা কারা এমনটা করলো, তা কেউ বলতে পারছে না।”

রাজধানীতে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ধারাবাহিকতা

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। কখনও মার্কেট, কখনও বাসাবাড়ি, আবার কখনও গণপরিবহনে আগুনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়গুলোতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়ে যায়।

মাত্র এক সপ্তাহ আগেই মিরপুর এলাকায় একটি মিনিবাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। তার আগেও গাবতলী ও আজিমপুর এলাকায় একাধিক বাসে আগুন দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় কারও প্রাণহানি না হলেও জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত শুরু

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল দুটি ঘিরে তদন্ত চলছে। বাসের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন ও বাসের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ।

তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। কারও ব্যক্তিগত ক্ষোভ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, কিংবা পরিবহন ব্যবসায়িক বিরোধ—যে কোনো কারণেই হতে পারে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।”

ভিক্টর পরিবহনের বক্তব্য

ভিক্টর পরিবহনের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের দুটি বাসই রাতে গ্যারেজে রাখা ছিল। আগুন লাগার সময় বাসে কেউ ছিলেন না। তিনি বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে একটি নাশকতা। কারণ বাস দুটি নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করা ছিল, সেখানে স্বাভাবিকভাবে আগুন লাগার কোনো সুযোগ ছিল না।”

তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের ঘটনা শুধু আমাদের ক্ষতি করছে না, বরং সাধারণ যাত্রীদেরও ক্ষতির মুখে ফেলছে। মানুষ এখন বাসে উঠতেও ভয় পাচ্ছে।”

অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ভোগান্তি

দুটি বাস পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ায় পরিবহন মালিকের কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া, এ ধরনের ঘটনা যাত্রীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সকালে অফিসগামী ও শিক্ষার্থীরা বাসের অপেক্ষায় পড়ে পড়েন বিপাকে।

শাহজাদপুর এলাকার যাত্রী রুবিনা আক্তার বলেন, “সকালে বাচ্চাকে স্কুলে দিতে বের হয়ে দেখি রাস্তায় বাস নেই। পরে জানতে পারলাম, রাতে বাসে আগুন দিয়েছে কেউ। এখন আবার রিকশা বা সিএনজি ধরতে হচ্ছে, ভাড়া দ্বিগুণ।”

রাজধানীতে অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

রাজধানীতে বারবার আগুন লাগার ঘটনায় নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নগরবাসী মনে করছেন, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরে এলোমেলোভাবে পার্ক করা বাস বা ট্রাক প্রায়ই আগুনের ঝুঁকিতে থাকে। রাতের বেলায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকলে দুর্বৃত্তরা সুযোগ নেয়।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চলমান রাজনৈতিক উত্তাপের প্রেক্ষাপটে এই অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়। অতীতে আন্দোলনের সময়ও এ ধরনের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির বলেন, “নির্বাচন ঘিরে দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়েছে। অতীতে যেমন গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ ঘটেছে, এবারও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি জনগণের জান-মালের জন্য ভয়াবহ হুমকি।”

নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ

ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে। অনেকেই বলছেন, সাধারণ মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা বাস, সেটিও এখন নিরাপদ নয়।

ঢাকার নাগরিক শারমিন ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, “বাসে আগুন দিয়ে কেউ কী অর্জন করছে? যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বের হয়, তারা এখন আরও বিপদে।”

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

সরকার ইতোমধ্যেই ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, দায়ীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত চলছে, এবং যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্ত্রী বলেন, “আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই—দেশে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পার পাবে না। আগুন দিয়ে আন্দোলন নয়, সংলাপ ও শান্তির পথই আমাদের লক্ষ্য।”

মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুরে ভিক্টর পরিবহনের দুটি বাসে আগুনের এই ঘটনা শুধু দুটি যানবাহনের ক্ষতি নয়, এটি পুরো নগরবাসীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি।
রাজধানীতে বারবার এ ধরনের নাশকতা সাধারণ মানুষের জীবনে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন প্রয়োজন সঠিক তদন্ত, দোষীদের আইনের আওতায় আনা এবং নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ঢাকাবাসীর প্রত্যাশা—রাজনীতি বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, নিরাপদ নগরী হোক সবার অঙ্গীকার।

MAH – 13712 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button