রাজবাড়ীতে জমি বিরোধের জেরে অন্ধ কৃষকসহ তিন ভাইয়ের ক্ষতি, ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ টাকার বেশি বলে দাবি
রাজবাড়ীর সদর উপজেলার বসন্তপুর ইউনিয়নের গাবলা গ্রামে রাতের আঁধারে এক অন্ধ কৃষকসহ তিন ভাইয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক কলাগাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জমি দখল সংক্রান্ত পুরনো বিরোধ থেকেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শনিবার (৮ নভেম্বর) দিনগত রাতে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্ধ কৃষকসহ তিন ভাইয়ের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেল
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কাদের মিজি বলেন,
“গাবলা মৌজায় আমার বাবার নামে ৪২ শতাংশ জমি দলিল করা আছে। বহু বছর ধরে আমরা জমিটি ভোগদখল করে আসছি। কিন্তু কয়েক মাস আগে স্থানীয় মানিক গাজি ও তার সহযোগীরা জোরপূর্বক আমাদের জমির অংশ দখল করতে চায়। আমরা আদালতের আশ্রয় নেই। এরপর থেকেই তারা আমাদের হুমকি দিতে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “শনিবার রাতে তারা বাগানে ঢুকে এলোমেলোভাবে কুপিয়ে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ কলাগাছ কেটে ফেলে। প্রতিটি গাছে কলাধরা ছিল। এতে দুই লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমরা এখন পুরোপুরি নিঃস্ব।”
“জমির আয় দিয়েই সংসার চলত”—অন্ধ হাসেম মিজির কান্না
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কৃষক হাসেম মিজি বলেন, “আমি চোখে দেখি না, কিন্তু জমির আয় দিয়েই আমার সংসার চলে। কলাগাছের ফল বিক্রি করে পরিবারের খরচ মেটাতাম। এখন সব শেষ করে দিয়েছে। ওরা জমি দখল করতে না পেরে রাতের অন্ধকারে আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চাই।”
অন্য ভাই মোতালেব মিজি বলেন, “এটি আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। দীর্ঘদিন আমরা চাষাবাদ করছি। কিন্তু কয়েক মাস ধরে মানিক গাজির দল বিএনপির প্রভাব দেখিয়ে আমাদের জমি দখলের চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হয়ে এখন কলাগাছ কেটে দিয়েছে।”
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: ‘বাধা দিতে গেলে হুমকি দেয়’
কাদের মিজির স্ত্রী লুৎফুন্নেছা জানান, “রাতে আমরা শব্দ শুনে বাইরে যাই। দেখি কয়েকজন লোক কলাগাছ কেটে ফেলছে। বাধা দিতে গেলে তারা বলে, ‘আমাদের দল এখন ক্ষমতায়, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফল ভালো হবে না।’ আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। সকালে দেখি সব গাছ কাটা পড়ে আছে।”
স্থানীয়রা জানান, জমির মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ দীর্ঘদিনের। সরকার পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনা থেকে বড় ধরনের সংঘর্ষও ঘটতে পারে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।
অভিযুক্তদের দাবি: ‘আমরাই মালিক, মিথ্যা অভিযোগ’
অভিযুক্ত মানিক গাজি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “ওই জমিটি ৪০ বছর আগে কাদের মিজির বাবার কাছ থেকে আমরা কিনে নিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের সময়ে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল করে নেয়। সরকার পরিবর্তনের পর আমরা নিজের জমি ফেরত নিয়েছি। সেখানে নতুন ফসল চাষের জন্য আগের কলাগাছগুলো কেটে ফেলেছি। তারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিতে চাইছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “এটি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। আমাকে হেয় করার জন্যই তারা এসব কথা বলছে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: প্রশাসনের হস্তক্ষেপের দাবি
গ্রামের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, “এলাকার মানুষ সবাই জানে, এই জমি নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ বহুদিনের। কিন্তু এমনভাবে রাতের আঁধারে কলাগাছ কেটে ফেলা অমানবিক। প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।”
আরেকজন স্থানীয় যুবক আব্দুল্লাহ বলেন, “এখানে আগেও ছোটখাটো ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু এবার ব্যাপারটা গুরুতর। অন্ধ মানুষের সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা চাই, দোষীদের শাস্তি হোক।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য
রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, “ঘটনাটি আমাদের নজরে এসেছে। এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে এখনো উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়নি।
পূর্ববর্তী বিরোধ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
স্থানীয়রা জানান, মানিক গাজি ও মিজি পরিবারের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ বহু বছর ধরে চলে আসছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ওই বিরোধ নতুন করে জটিল রূপ নিয়েছে। দুই পক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ।
এলাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গ্রামীণ পর্যায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তন অনেক সময় পুরনো বিরোধকে উসকে দেয়। ফলে জমি-সম্পত্তি নিয়ে সংঘাত বাড়ে।
গ্রামীণ বিরোধে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের প্রয়োজন
স্থানীয় উন্নয়নকর্মীরা মনে করছেন, এ ধরনের জমি বিরোধের ঘটনায় দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিলে তা বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। তারা বলছেন, গ্রামীণ এলাকায় জমি সংক্রান্ত বিরোধ এখন বড় সামাজিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে।
একজন সমাজকর্মী বলেন, “যদি প্রতিটি বিরোধ আদালত বা প্রশাসনের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যেত, তাহলে কেউই এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। বিশেষ করে অন্ধ কৃষকের মতো অসহায় মানুষদের ক্ষেত্রে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি।”
রাজবাড়ীর গাবলা গ্রামে রাতের আঁধারে কলাগাছ কেটে দেওয়ার এই ঘটনাটি কেবল তিন ভাইয়ের পরিবারকেই নয়, পুরো এলাকার মানুষকেও ব্যথিত করেছে। প্রশাসন যদি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় না আনে, তাহলে এই ধরণের নাশকতামূলক ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
ভুক্তভোগী পরিবার এখন সরকারের প্রতি একটাই আবেদন জানিয়েছে—“ন্যায়বিচার চাই, যেন এমন ঘটনা আর কারও জীবনে না ঘটে।”
এম আর এম – ২১৫৫,Signalbd.com



