দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত ও বাম্পার ফলন থাকা সত্ত্বেও বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না এলে সরকার বাধ্য হয়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নেবে।
রবিবার বিকেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
দেশে পর্যাপ্ত মজুত, তবু দাম বেড়েছে
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, দেশে এ বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ বাজারের চাহিদার চেয়েও বেশি। ফলে কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়।
তবে গত এক সপ্তাহে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে, যা অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “দেশে কোনো ঘাটতি নেই। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। এর মধ্যেও যদি মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসে, তাহলে আমরা আমদানির অনুমোদন দিতে বাধ্য হব।”
আমদানি অনুমোদনের প্রস্তুতি চলছে
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে পেঁয়াজ আমদানির জন্য প্রায় ২ হাজার ৮০০টি আবেদন জমা পড়েছে। উপদেষ্টা জানান, এই আবেদনগুলোর মধ্যে যদি মাত্র ১০ শতাংশও অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ চলে আসবে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “আমরা চাই না কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ুক। তাই সব দিক বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু যদি কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে রাখে, তাহলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না।”
দাম বৃদ্ধির পেছনের কারণ
বাণিজ্য উপদেষ্টা পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন।
তার মতে, মৌসুমের শেষ দিকে পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কমে যায়, ফলে প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি হয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক ভারী বৃষ্টিপাতে সংরক্ষিত পেঁয়াজের কিছু অংশ নষ্ট হয়েছে, যা বাজারে প্রভাব ফেলেছে।
আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “পেঁয়াজ সংরক্ষণের সময় শুকিয়ে ওজন কমে যায়। ফলে বাজারে যে পরিমাণ সরবরাহ আছে, তা কাগজে থাকা মজুতের তুলনায় কিছুটা কম মনে হয়। এটিও দাম বাড়ার একটি কারণ।”
সীমান্তে মজুতের অভিযোগ
শেখ বশিরউদ্দীন আরও জানান, ভারত সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রচুর পেঁয়াজ মজুত করা হচ্ছে বলে সরকারের কাছে খবর এসেছে। এতে সীমান্তের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরাও বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
তিনি বলেন, “আমরা সব তথ্য খতিয়ে দেখছি। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সিন্ডিকেট বা মজুতদারদের ভূমিকা আছে কি?
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট বা মজুতদারদের ভূমিকা আছে কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “আমার কাছে এখনো কোনো সিন্ডিকেটের প্রমাণ আসেনি। বাজারে সাময়িক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা কয়েক দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি।”
তিনি আরও বলেন, সরকার বাজার মনিটরিং জোরদার করেছে এবং প্রতিদিনই জেলা পর্যায়ে মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে বাজার তদারকি করা হচ্ছে।
অতীতে এমন পরিস্থিতি
এর আগেও দেশে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সরকার কয়েকবার আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একই পরিস্থিতিতে ভারত থেকে সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এতে কয়েক দিনের মধ্যেই বাজারে স্থিতি ফিরে আসে।
এবারও সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সরকার বাজার পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান উপদেষ্টা।
মতামত
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পেঁয়াজের দামের এই অস্থিরতা সাময়িক। তাদের মতে, দেশে পর্যাপ্ত মজুত এবং নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার সময় ঘনিয়ে আসায় দাম দ্রুত কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমদানির হুঁশিয়ারি সাধারণত বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। পাইকাররা বুঝতে পারে, সরকার প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে। ফলে দাম নিজেরাই কমিয়ে দেয়।”
সরকারের অবস্থান: বাজারে অস্থিরতা সহ্য করা হবে না
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, বাজারে অযৌক্তিকভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ালে তার দায় ব্যবসায়ীদেরই নিতে হবে।
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমরা চাই বাজারে স্থিতি আসুক। কিন্তু কেউ যদি পরিস্থিতির সুযোগ নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।”
দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও মজুত থাকা সত্ত্বেও দামের উর্ধ্বগতি সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই বাজারের অবস্থা অনেকটা নির্ধারিত হবে। দাম যদি সহনীয় পর্যায়ে না আসে, তাহলে দ্রুত আমদানি অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, সরকার ও বাজার কত দ্রুত একসঙ্গে কাজ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে পারে।
এম আর এম – ২১৫৪,Signalbd.com



