বিশ্ব

আল্লামা ইকবালের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী: পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপন

Advertisement

পাকিস্তানজুড়ে পালিত হচ্ছে উপমহাদেশের খ্যাতনামা কবি, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল-এর ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী। জাতীয়ভাবে দিনটি উদযাপন করতে দেশজুড়ে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে এই মহান ব্যক্তিত্বকে, যিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক চেতনা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিলেন।

ইকবালের মাজারে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও দোয়া অনুষ্ঠান

লাহোরে অবস্থিত আল্লামা ইকবালের সমাধিস্থলে সকাল থেকেই জমে ওঠে শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন। মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় গার্ড অব অনার ও রক্ষী পরিবর্তনের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। এতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহেল আহমেদ আজমি, যিনি নৌবাহিনীর পাঞ্জাব সেন্ট্রাল কমান্ডের অধিনায়ক। তিনি ইকবালের মাজারে ফাতেহা পাঠ, ফুল অর্পণ ও সেনাদের সালাম গ্রহণ করেন। পরে অতিথি বইতে অনুভূতি ব্যক্ত করে স্বাক্ষর করেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন,

“আল্লামা ইকবাল শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন একটি জাতির জাগরণের প্রেরণা। তার চিন্তাধারা আজও তরুণ প্রজন্মকে সাহস জোগায়।”

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ আলাদা বার্তা দিয়ে আল্লামা ইকবালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধা জানান এবং তাঁর দর্শনের আধুনিক প্রয়োগের আহ্বান জানান।

রাষ্ট্রপতি জারদারি বলেন,

“আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলেছিলেন। ১৯৩০ সালের অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে তাঁর দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণই স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর জীবন ও আদর্শ আমাদের জাতিকে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দেয়।”

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেন,

“ইকবাল ছিলেন এমন এক দার্শনিক, যিনি অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছেন। তিনি আমাদের আত্মচেতনা ও স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছেন। আজকের তরুণদের উচিত তাঁর আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা।”

আল্লামা ইকবালের জীবন ও কর্ম

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান পাকিস্তানের) শিয়ালকোটে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়েখ নূর মুহাম্মদ ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম ও আধ্যাত্মিক মানুষ। শৈশব থেকেই ইকবাল ছিলেন মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে দর্শন, আরবি ও ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে পাড়ি জমান। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় এবং লিংকনস ইন থেকে তিনি দর্শন, আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

ইউরোপে অবস্থানকালে পশ্চিমা চিন্তাধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটলেও, তিনি ইসলামি দর্শনের ভেতরেই মানবমুক্তির পথ খুঁজে পান। এই সময় তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কবিতা ও প্রবন্ধসমূহ, যা পরে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে।

ইকবালের দর্শন ও পাকিস্তান আন্দোলনে প্রভাব

১৯৩০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশনে আল্লামা ইকবালের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের জন্য ছিল দিকনির্দেশক। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন—যা পরবর্তীতে পাকিস্তানের জন্মের ভিত্তি স্থাপন করে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম শুধু ধর্ম নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা সামাজিক ন্যায়, সমতা এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত। তাঁর কবিতা ও চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়েছে মুসলিম জাতিসত্তা, আত্মসম্মান ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।

ইকবাল একবার বলেছিলেন—

“নিজেকে চিনো, তাহলেই আল্লাহকে চিনবে। আত্মজ্ঞানই মানুষকে মুক্তি দেয়।”

এই উক্তি তাঁর সমগ্র দর্শনের সারমর্ম তুলে ধরে।

বিশ্বসাহিত্যে আল্লামা ইকবালের অবদান

ইকবাল ছিলেন উর্দু ও ফারসি—দুই ভাষারই মহান কবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাং-এ-দারা’, ‘আসার-এ-খুদি’, ‘রুমুজ-এ-বেখুদি’, ‘পায়াম-এ-মাশরেক’, এবং ‘জাবরিদা’
তিনি ইসলামী চেতনা, আত্মউন্নয়ন, স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধকে তাঁর কবিতায় এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তাঁকে ‘মুফাক্কির-এ-পাকিস্তান’ (পাকিস্তানের চিন্তানায়ক) বলা হয়।

তাঁর রচনাগুলো শুধু সাহিত্য নয়, বরং ছিল একটি জাতির জাগরণের আহ্বান। মুসলিম যুবসমাজের প্রতি তাঁর বার্তা ছিল স্পষ্ট—আত্মসম্মান অর্জন করো, নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনে নাও, এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে চল।

ইন্তেকাল ও উত্তরাধিকার

১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল, মাত্র ৬০ বছর বয়সে লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান দার্শনিক। তাঁকে সমাহিত করা হয় লাহোরের ঐতিহাসিক বাদশাহী মসজিদ এবং লাহোর দুর্গের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত হুজুরিবাগে। তাঁর সমাধিস্থলটি এখন পাকিস্তানের অন্যতম জাতীয় স্মৃতিসৌধ, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসে।

আজও তাঁর কবিতা ও দর্শন পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাঁর চিন্তাধারা আধুনিক ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তায় একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

আজকের প্রজন্মের কাছে ইকবালের প্রাসঙ্গিকতা

ডিজিটাল যুগে বসবাসরত নতুন প্রজন্মের জন্য আল্লামা ইকবালের বার্তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায়, নৈতিকতা ও বিশ্বাস—এই চারটি স্তম্ভের ওপরই তিনি জাতি গঠনের দর্শন দাঁড় করিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজ বিশেষ ক্লাস, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইকবালের চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষাবিদদের মতে, “ইকবাল শুধু পাকিস্তানেরই নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর দর্শন মানবতার শিক্ষা দেয়, আর তাঁর কবিতা স্বাধীনতার আগুন জ্বালায়।”

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ইকবাল দিবসের তাৎপর্য

প্রতি বছর ৯ নভেম্বর পাকিস্তানে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় “ইকবাল দিবস” হিসেবে।
দেশের প্রতিটি প্রদেশে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, ও আলোচনা সভা।
রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সারাদিন ধরে প্রচার করে তাঁর লেখা গান, কবিতা ও জীবনীভিত্তিক তথ্যচিত্র।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও, বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, ইরান ও তুরস্কে বিভিন্ন ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন এই দিনটি স্মরণ করে থাকে।

আল্লামা ইকবাল ছিলেন কেবল একজন কবি নন—তিনি ছিলেন এক যুগের চিন্তানায়ক, যিনি কলমের মাধ্যমে একটি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন এঁকেছিলেন। তাঁর কবিতা যেমন হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তেমনি তাঁর দর্শন একটি আদর্শ জীবন গঠনের দিশা দেয়।
আজ তাঁর জন্মদিনে পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে তাঁকে স্মরণ করা মানে কৃতজ্ঞচিত্তে সেই আলোকে ফিরে দেখা, যা এখনও মানবতার মুক্তির পথ দেখায়।

MAH – 13705 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button