বিশ্ব

যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলা, নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৬৯ হাজার

Advertisement

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও গাজার মাটি এখনও রক্তে রঙিন। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন লাশ। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মৃতদেহ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে শহীদের তালিকা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৬৯ হাজার ১৬৯ জনে পৌঁছেছে। আহতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে।

গাজায় শান্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ

গত অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, গাজায় আক্রমণ বন্ধ রাখার কথা ছিল ইসরায়েলের। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো চিত্র। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলি ড্রোন, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান প্রতিদিনই গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে। চুক্তির অংশ হিসেবে “ইয়েলো লাইন” নামের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে ইসরায়েলি সেনাদের পিছু হটার কথা। কিন্তু সেখানেই এখন নতুন সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।

শনিবার ইসরায়েলি সেনারা দাবি করেছে, উত্তর গাজায় সীমারেখা অতিক্রম করে একজন ফিলিস্তিনি তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন—তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণ গাজাতেও একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যাকে সেনারা “তাৎক্ষণিক হুমকি” বলে বর্ণনা করেছে।

বেসামরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ

গাজা প্রশাসন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই হামলাগুলোর অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো হচ্ছে। অনেক পরিবার যুদ্ধবিরতির আশায় ধ্বংসস্তূপে ফিরে ঘরবাড়ি খুঁজতে গেলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে।
খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতাল জানিয়েছে, ফেলে যাওয়া বিস্ফোরকের আঘাতে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছে।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দাবি, “ইসরায়েলি সেনারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে অমান্য করে গাজায় নতুন করে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এটা সুস্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।”

মানবিক সংকট চরমে

গাজা এখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য, ওষুধ, পানি ও জ্বালানির তীব্র সংকটে লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, ডাক্তাররা দিনে ২০ ঘণ্টা কাজ করেও রোগীদের সামলাতে পারছেন না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ৪ হাজার ফিলিস্তিনি রোগী রাফাহ সীমান্ত পেরিয়ে মিসর ও অন্যান্য দেশে চিকিৎসার জন্য গেছেন। তবে আরও ১৬ হাজার ৫০০ জন চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছেন, যাদের অনেকেই গুরুতর আহত।

ডব্লিউএইচও’র মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রতিনিধি রিচার্ড ব্রেনান বলেন,
“গাজার হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়ছে। প্রতিদিন শত শত আহত মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করছি, যেন রাফাহ সীমান্ত অবিলম্বে খোলা হয়।”

পশ্চিম তীরে সহিংসতা ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলা বৃদ্ধি

শুধু গাজা নয়, পশ্চিম তীরজুড়েও ইসরায়েলি সহিংসতা বেড়ে গেছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে ইসরায়েলি সেনা অভিযান ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
শনিবার দক্ষিণ নাবলুসের বেইতা শহরে জলপাই সংগ্রহে থাকা গ্রামবাসী, কর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় মুখোশধারী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা।

ইসরায়েলি মানবাধিকারকর্মী জোনাথন পোলাক বলেন,
“তারা পাহাড় থেকে নেমে বড় বড় পাথর ও লাঠি নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা পালিয়ে না এলে হয়তো কেউ বেঁচে থাকতাম না।”

এই হামলায় অন্তত এক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, বৃদ্ধ ও নারী। আহতদের অনেককে হাসপাতালে নিতে হয়েছে।

প্যালেস্টাইন জার্নালিস্টস সিন্ডিকেট জানিয়েছে, পাঁচজন সাংবাদিক — রানিন সাওয়াফতে, মোহাম্মদ আল-আত্রাশ, লুয়াই সাঈদ, নাসের ইশতাইয়েহ ও নাঈল বুয়াইতেল — আহত হয়েছেন। সংগঠনটি এই ঘটনাকে “সাংবাদিক হত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে।

রয়টার্সও নিশ্চিত করেছে, তাদের দুই কর্মী — একজন সাংবাদিক ও তার নিরাপত্তা পরামর্শক — হামলায় আহত হয়েছেন।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে পশ্চিম তীরের অন্তত ৭০টি শহর ও গ্রামে ১২৬টি হামলা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৪ হাজার জলপাই গাছ ধ্বংস করা হয়েছে। এই গাছগুলোই বহু ফিলিস্তিনি পরিবারের জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন,
“যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলি সামরিক হামলা অব্যাহত রাখা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন। আমরা অবিলম্বে যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধের আহ্বান জানাই।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কূটনৈতিক পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে নিন্দা জানায়নি, বরং তারা বলেছে—“ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।”

বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের দ্বিমুখী অবস্থানই ইসরায়েলকে আরও সাহসী করে তুলছে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক রামি খালিদ বলেন,
“যখন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় না, তখন ইসরায়েল এটিকে নীরব সমর্থন হিসেবে ধরে নেয় এবং হামলা চালিয়ে যায়।”

শিশু ও নারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিহতদের প্রায় ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু। প্রতিদিনই নতুন করে শিশুদের লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজার প্রতিটি শিশু এখন মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে বাস করছে।
তাদের অনেকেই বাবা-মাকে হারিয়েছে, অনেকের শরীরে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেছেন,
“এটি কেবল যুদ্ধ নয়, এটি প্রজন্মের ধ্বংস। শিশুদের ভবিষ্যৎ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।”

ফিলিস্তিনি জনগণের দৃঢ়তা ও আন্তর্জাতিক সংহতি

বিপর্যয়ের মাঝেও ফিলিস্তিনিদের দৃঢ় মনোবল বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করছে। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে তারা বলছে—“আমরা হার মানব না।”
বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ হচ্ছে, লন্ডন, প্যারিস, ইস্তাম্বুল, কায়রো ও জাকার্তা সহ বিশ্বের বড় বড় শহরে মানুষ গাজায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি তুলছে।

বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজ যুদ্ধবিরতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় বোমা, ধোঁয়া ও মৃত্যু—এই দৃশ্য যেন স্থায়ী চিত্রে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বিবেক এখনও জাগছে না। গাজার প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ, প্রতিটি লাশ, প্রতিটি শিশুর কান্না আজ প্রশ্ন তুলছে—মানবতা কি কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ?

এই চলমান সহিংসতা যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমগ্র বিশ্বের শান্তি হুমকির মুখে পড়বে।

MAH – 13683 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button