সরকারি হাসপাতালে ভুল রক্ত দেওয়ায় ঝাড়খণ্ডে আলোড়ন, বরখাস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে সরকারি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে নেওয়া রক্ত সঞ্চালনের পর পাঁচ শিশু এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। পশ্চিম সিংভূম জেলার সদর হাসপাতালে এই ঘটনাটি ঘটেছে, যা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। আক্রান্ত শিশুরা সবাই থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছিল এবং নিয়মিত রক্ত নিতে হতো তাদের।
রক্ত নেওয়ার পরই জানা যায় সংক্রমণের বিষয়টি
জেলার ম্যাজিস্ট্রেট চন্দন কুমার নিশ্চিত করেছেন, সদর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে নেওয়া রক্তের মাধ্যমেই পাঁচটি শিশুর শরীরে এইচআইভি ভাইরাস প্রবেশ করেছে। শিশুদের বয়স আট বছরের নিচে। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর হাসপাতালের সিভিল সার্জন, এইচআইভি ইউনিটের চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আক্রান্ত এক শিশুর মা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, “সেপ্টেম্বর মাসে মেয়েকে রক্ত দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। রক্ত দেওয়ার পর থেকেই ডাক্তারদের আচরণ অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। পরে একজন স্বাস্থ্যকর্মী জানায়, ভুল রক্ত দেওয়ার ফলে আমার মেয়ে এইচআইভি পজিটিভ হয়ে গেছে।”
ক্ষতিপূরণের ঘোষণা ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে প্রত্যেককে দুই লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুরো ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চন্দন কুমার বলেন, “২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এই জেলায় ২৫৯ জন দাতা রক্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে ৪৪ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে এবং চারজন দাতার রক্ত এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া গেছে। বাকি দাতাদের রক্তও পুনরায় পরীক্ষা করা হচ্ছে।”
রক্ত পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় গাফিলতি ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি
ঝাড়খণ্ডের বিশেষ স্বাস্থ্য সচিব ডা. নেহা অরোরা জানিয়েছেন, রক্ত পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় অনিয়মের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে এখনো পুরনো প্রি-কিট ব্যবহার করা হয়, যা ভাইরাস শনাক্তে দেরি করে। এখন থেকে শুধুমাত্র এলিসা বা এনএটি টেস্টের মাধ্যমে রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, এইচআইভি সনাক্তে আধুনিক এনএটি টেস্ট ব্যবহারের মাধ্যমে ‘উইন্ডো পিরিয়ড’ কমানো সম্ভব, যা রোগ নির্ণয়ে দ্রুত সহায়তা করে।
চিকিৎসা অবহেলায় ক্ষুব্ধ পরিবার ও মানবাধিকারকর্মীরা
আক্রান্ত পরিবারগুলো হাসপাতালের অবহেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এক অভিভাবক জানান, “আমাদের সন্তানদের জীবন এখন অনিশ্চিত। সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কে দেবে আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ?”
অ্যাক্টিভিস্ট অতুল গেরা বলেছেন, “ঝাড়খণ্ডে পাঁচ হাজারেরও বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে, অথচ রাজ্যজুড়ে একজন মাত্র হেমাটোলজিস্ট কাজ করছেন। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে কত বড় ঘাটতি রয়েছে।”
থ্যালাসেমিয়া ও রক্ত সঞ্চালনের ঝুঁকি
থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক রক্তজনিত রোগ, যেখানে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন ছাড়া রোগী বাঁচতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্ত সঞ্চালনের আগে প্রতিটি ব্যাগের সঠিক স্ক্রিনিং অত্যন্ত জরুরি।
ভারতের ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের (NACO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি ইউনিট রক্ত সংগৃহীত হয়, যার মধ্যে মাত্র ১% ক্ষেত্রে ত্রুটি ধরা পড়ে। তবে এমন একটি ছোট ত্রুটিও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যেমনটি ঘটেছে ঝাড়খণ্ডে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা নাকি সিস্টেমের ত্রুটি?
স্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ হলো প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অভাব। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামচন্দ্র চন্দ্রবংশী বলেন, “রক্ত পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় গাফিলতি ছিল। সিভিল সার্জন ও ব্লাড ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না।”
তিনি আরও বলেন, “রক্তদান ও রক্ত পরীক্ষার জন্য একক নীতিমালা না থাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তদন্ত চলছে, ভবিষ্যতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস
প্রাদেশিক সরকার জানিয়েছে, ঘটনাটির বিস্তারিত তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি রাজ্যের সব সরকারি ব্লাড ব্যাংকে বিশেষ অডিট শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্য সচিব নেহা অরোরা বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এমন ঘটনা আর কখনো না ঘটে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঝাড়খণ্ডের এই ঘটনাটি ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তুলেছে। যেখানে শিশুর জীবন রক্ষায় দেওয়া রক্তই তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়, সেখানে কঠোর নজরদারি ছাড়া ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকানো কঠিন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা শুধু চিকিৎসা অবহেলার উদাহরণ নয় — এটি সতর্কবার্তা, যে স্বাস্থ্যসেবায় যতটুকু প্রযুক্তি আসে, ততটাই প্রয়োজন জবাবদিহি ও মানবিক দায়িত্বশীলতা।
এম আর এম – ২১৩৬,Signalbd.com



