শিক্ষা

আগামীকাল থেকে সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

Advertisement

তিন দফা দাবি আদায় ও পুলিশি হামলার প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা দিলেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দশম গ্রেডে বেতনসহ তিন দফা দাবি আদায়ে আগামীকাল রবিবার (৯ নভেম্বর) থেকে সারাদেশে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে এই ঘোষণা দেন শিক্ষক সংগঠনের নেতারা।

এর আগে শাহবাগে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশি বাধা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান নিক্ষেপের ঘটনায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় বহু শিক্ষক আহত হন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

তিন দফা দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা

শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারা জানান, সরকারের কাছে তাদের তিনটি মূল দাবি রয়েছে —
১. সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম থেকে দশম গ্রেডে উন্নীত করা,
২. প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর করা,
৩. পুলিশি হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার।

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, “আমরা বহু বছর ধরে যৌক্তিক দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার কথা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আগামীকাল থেকে সারা দেশে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি চলবে।”

তিনি আরও জানান, রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন, এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

শাহবাগে সংঘর্ষ ও আহতের ঘটনা

শনিবার বিকেলে আন্দোলনরত শিক্ষকরা শহীদ মিনার থেকে শাহবাগের দিকে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে।

শিক্ষক নেতাদের দাবি, বিনা উস্কানিতে পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে শতাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন, যার মধ্যে কয়েকজন গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল ও পিজি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

এক শিক্ষক জানান, “আমাদের কপালে ও হাতে রাবার বুলেট লেগেছে। কেউ কেউ রাস্তায় পড়ে গেছেন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলাম।”

পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নতুন ঘোষণা

পুলিশি বাধার পর আন্দোলনরত শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফিরে আসেন এবং সেখানেই সারাদেশে কর্মবিরতির নতুন ঘোষণা দেন। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, “শিক্ষকদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু হামলার নিন্দা না করে তারা এখনো নীরব।”

তিনি জানান, শনিবার রাত থেকেই সারাদেশের শিক্ষকরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রবিবার থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ থাকবে, এবং শিক্ষকরা তাদের অবস্থান থেকে দাবি আদায়ের কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও সতর্কবার্তা

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার শনিবার সকালে খুলনায় বলেন, “সহকারী শিক্ষকদের এক ধাপে দশম গ্রেডে আনা সম্ভব নয়। সরকার ধাপে ধাপে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার পরিকল্পনায় কাজ করছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে আন্দোলন অযৌক্তিক। পাঠদান বন্ধ করে আন্দোলনে গেলে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।”

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হলে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

শিক্ষকদের অবস্থান: “আমরা সম্মান চাই, সংঘাত নয়”

আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, তারা সংঘাত চান না, বরং মর্যাদা ও ন্যায্য গ্রেড চান। এক শিক্ষক বলেন, “আমরা ছাত্রদের ভবিষ্যৎ গড়ি, অথচ নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বহু বছর ধরে একই গ্রেডে পড়ে আছি। সরকারের উচিত বাস্তব সমাধান দেওয়া।”

অন্যদিকে, শিক্ষক সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করা সম্ভব নয়।

দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রতিবাদ

সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের পদোন্নতি ও বেতন কাঠামো উন্নয়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলের পর থেকে তারা ১৩তম গ্রেডে রয়েছেন।

এর আগে ২০২২ ও ২০২৩ সালে তারা কয়েকবার কর্মবিরতি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট সমাধান মেলেনি। শিক্ষকরা মনে করছেন, তাদের দাবি ন্যায্য, কারণ প্রধান শিক্ষকদের তুলনায় তাদের দায়িত্ব ও কাজের চাপ প্রায় সমান।

শিক্ষা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

শিক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিক্ষক সমাজের দাবিগুলো শোনা দরকার, তবে আলোচনা ছাড়া সংঘাতে যাওয়া শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর। শিক্ষা বিশ্লেষক ড. রুহুল আমিন বলেন, “শিক্ষকদের আন্দোলন শিক্ষা ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সরকার ও শিক্ষক সংগঠনের দ্রুত আলোচনায় বসা উচিত।”

তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রশাসনের উচিত উভয় পক্ষের দাবি ও বাস্তবতা বিবেচনা করে সমাধান খোঁজা।”

শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণার ফলে রবিবার থেকে দেশের প্রায় ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান না হলে শিক্ষার মান ও পাঠদান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সরকার ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমেই এই অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এম আর এম – ২১৩৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button