কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে আবারও ইতিহাসের অপেক্ষা
কাতার বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেই রোমাঞ্চকর ফাইনালের পর এবার আবারও আলো ঝলমল করতে যাচ্ছে দোহা শহরের লুসাইল স্টেডিয়াম। ২০২৬ সালের মার্চ মাসেই অনুষ্ঠিত হবে আরেকটি ফুটবল মহারণ—ফিনালিসিমা ২০২৬।
ইউরোপের সেরা স্পেন ও দক্ষিণ আমেরিকার রাজা আর্জেন্টিনার এই লড়াই ইতিমধ্যে ফুটবলভক্তদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা শনিবার (৮ নভেম্বর ২০২৫) নিশ্চিত করেছে, ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের ২৭ মার্চ। ইউরোপীয় ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফা এবং দক্ষিণ আমেরিকার সংস্থা কনমেবল যৌথভাবে আয়োজন করছে এই বহুল প্রতীক্ষিত ম্যাচটি।
ফিনালিসিমা কী? সংক্ষেপে ইতিহাস
‘ফিনালিসিমা’ শব্দটি এসেছে ইতালীয় ভাষা থেকে, যার অর্থ “সবচেয়ে বড় ফাইনাল”। এটি মূলত ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন দলের মধ্যে একটি প্রতীকী সুপার কাপ ম্যাচ।
এই আয়োজনের সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে, যখন প্রথমবার ফ্রান্স ও উরুগুয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ট্রফি দে কাম্পিওনেস। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ২০২২ সালে আর্জেন্টিনা ও ইতালির মধ্যকার ম্যাচের মাধ্যমে ফিনালিসিমা আবারও ফিরে আসে ফুটবল মানচিত্রে।
২০২২ সালে লিওনেল মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয় করে। এবারও ফিনালিসিমার শিরোপা রক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতেই।
লুসাইল—একটি স্মৃতিময় মাঠ
কাতারের মরুভূমিতে নির্মিত লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম কেবল একটি মাঠ নয়, এটি এখন ফুটবলের ইতিহাসের এক অংশ।
২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালও এই স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে মেসির আর্জেন্টিনা ৩-৩ গোলে ফ্রান্সকে রুদ্ধশ্বাস ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়।
আবারও সেই মাঠেই মেসির দল মাঠে নামবে—যদিও এবার প্রতিপক্ষ ইউরোপীয় জায়ান্ট স্পেন। ফলে লুসাইল আবারো ফুটবল উন্মাদনায় ভরবে সেটাই স্বাভাবিক।
দুই দলের বর্তমান অবস্থা
২০২২ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে আর্জেন্টিনা তাদের সোনালী সময় পার করছে। কোচ লিওনেল স্কালোনির তত্ত্বাবধানে দলটি এখনও অপরাজিত রয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। মেসি, দি মারিয়া, লাউতারো মার্টিনেজদের অভিজ্ঞতা এবং এনজো ফার্নান্দেজ, জুলিয়ান আলভারেজের তরুণ উদ্যম দলটিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
অন্যদিকে স্পেনও নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। লুইস দে লা ফুয়েন্তের অধীনে দলটি ইউরো ২০২৪ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এখন আত্মবিশ্বাসের চূড়ায়। তরুণ প্রতিভা লামিন ইয়ামাল, গাভি, পেদ্রি এবং অভিজ্ঞ রদ্রি মিলে স্পেনকে আবারও ইউরোপীয় ফুটবলের শীর্ষে তুলেছে।
এবার সেই সাফল্যকে আন্তর্জাতিক মহারণে প্রমাণ করতে চায় তারা।
নতুন জার্সিতে নতুন উত্তেজনা
এই ম্যাচে দুই দলই মাঠে নামবে সম্পূর্ণ নতুন অ্যাওয়ে জার্সি পরে।
স্পেনের জন্য অ্যাডিডাস তৈরি করেছে সাদা রঙের পোশাক, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী লাল জার্সির বিপরীতে এক ভিন্ন সৌন্দর্য প্রকাশ করবে।
অন্যদিকে, আর্জেন্টিনা নামবে কালো রঙের পোশাকে, যা তাদের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের মর্যাদার সঙ্গে মানানসই এক শক্তিশালী উপস্থিতি এনে দেবে।
কেন এই ম্যাচ এত গুরুত্বপূর্ণ
ফিনালিসিমা শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনী ম্যাচ নয়; এটি দুই মহাদেশের ফুটবল সংস্কৃতির প্রতীক। ইউরোপের কৌশল আর দক্ষিণ আমেরিকার আবেগ একত্রিত হয় এই মঞ্চে।
ফুটবল বোদ্ধাদের মতে, এই ম্যাচ বিশ্বকাপের বাইরে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আন্তঃমহাদেশীয় লড়াই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই ম্যাচ শুধু ট্রফির নয়, এটি মর্যাদার যুদ্ধ। আর্জেন্টিনা চায় তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে, আর স্পেন চায় নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে বিশ্বে নিজেদের পুনরায় প্রমাণ করতে।”
মেসি কি খেলবেন?
সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন—লিওনেল মেসি কি ফিনালিসিমায় খেলবেন?
যদিও মেসি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামি দলে খেলছেন, তবুও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দেখা যায় তাঁকে নিয়মিতই।
ফুটবল বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মেসি অন্তত এই ম্যাচ পর্যন্ত জাতীয় দলের সঙ্গে থাকবেন, কারণ এটি তাঁর জন্য এক প্রকার আবেগের বিষয়।
তিনি ২০২২ সালে যেমন ফিনালিসিমা জিতেছিলেন, এবার হয়তো সেটি হবে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ‘ফিনালিসিমা’ ম্যাচ।
দর্শক উত্তেজনা: টিকিট বিক্রি ও সম্প্রচার
কাতারে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে টিকিট বিক্রির প্রস্তুতি। আয়োজক কমিটি জানিয়েছে, লুসাইল স্টেডিয়ামের ৮৮,০০০ আসনের প্রতিটিই পূর্ণ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বের প্রায় সব বড় ক্রীড়া চ্যানেল—ESPN, beIN Sports, Sony Sports Network—ইতোমধ্যে ম্যাচটি সম্প্রচারের আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের জন্যও এটি হতে যাচ্ছে বড় এক উৎসব। আর্জেন্টিনা-স্পেন মানেই উত্তেজনা, আবেগ, এবং এক রাতের জন্য ফুটবলের রাজত্ব।
লুসাইলের প্রস্তুত
কাতার সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্টেডিয়ামটি ইতোমধ্যে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে। নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, উন্নত আলো, পরিবেশবান্ধব কুলিং সিস্টেম ও উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিশ্বকাপের পর প্রথমবার এই মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হতে যাচ্ছে, যা কাতারের জন্যও গর্বের বিষয়।
ফুটবলবিশ্বের প্রতিক্রিয়া
ফিফা ও উয়েফা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই ম্যাচ ফুটবলের বৈশ্বিক ঐক্যের প্রতীক হবে। দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে এই আয়োজনের মাধ্যমে।
কনমেবল প্রেসিডেন্ট আলেহান্দ্রো ডোমিনগেজ এক বিবৃতিতে বলেন,
“ফিনালিসিমা শুধু একটি ম্যাচ নয়; এটি দুই মহাদেশের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আমরা আশা করি, এই আয়োজন বিশ্বজুড়ে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে আরও গভীর করবে।”
সম্ভাব্য একাদশ (পূর্বাভাস)
আর্জেন্টিনা: মার্টিনেজ, মোলিনা, ওতামেন্ডি, রোমেরো, টাগলিয়াফিকো, এনজো, মাক অ্যালিস্টার, দি মারিয়া, মেসি, আলভারেজ, লাউতারো।
স্পেন: উনাই সিমন, কার্ভাহাল, লাপোর্ত, কুকুরেলা, রদ্রি, গাভি, পেদ্রি, মেরিনো, ইয়ামাল, ওলমো, মোরাতা।
এই দুই দল মুখোমুখি হলে মাঠে যে এক অনন্য কৌশলগত লড়াই হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
ফিনালিসিমা ২০২৬ শুধু একটি ম্যাচ নয়, এটি দুই ফুটবল মহাদেশের সেরা খেলোয়াড়দের মহারণ।
কাতারের লুসাইল আবারও হয়ে উঠবে আবেগের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে হয়তো শেষবারের মতো আমরা দেখতে পাবো মেসির জাদু ও নতুন প্রজন্মের স্প্যানিশ ফুটবলের উত্থান।
বিশ্বজুড়ে কোটি ফুটবলপ্রেমী অপেক্ষায় সেই দিনটির, যখন লুসাইলের আলোয় আবারও ফুটবলের ইতিহাস লেখা হবে নতুন করে।
সংবাদ সংক্ষেপে:
- ম্যাচের তারিখ: ২৭ মার্চ ২০২৬
- স্থান: লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম, কাতার
- দল: আর্জেন্টিনা বনাম স্পেন
- আয়োজক: উয়েফা ও কনমেবল
- বর্তমান চ্যাম্পিয়ন: আর্জেন্টিনা
- পূর্বের আসর: ২০২২, ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম
MAH – 13676 I Signalbd.com



