বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর গ্রামে করতোয়া নদী যেন জীবনের রসধারা। আঁকাবাঁকা এই নদীর তীরে প্রতিদিন সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এক অন্য রকম ব্যস্ততা। কারও হাতে কাস্তে, কারও হাতে সেচের পাইপ, কারও হাতে চারা। ফসল ফলানোর এই প্রভাতের গল্প শুধু কৃষকের নয়—এটা বাংলাদেশের কৃষি জীবনের প্রতিচ্ছবি।
প্রতিদিন ভোরে যখন নদীর ওপরে কুয়াশা ভেসে বেড়ায়, তখন করতোয়ার পাড়ের কৃষকেরা নেমে পড়েন জমিতে। কেউ মাটি ঝরিয়ে জমি তৈরি করছেন, কেউ নল টেনে আনছেন খেতে সেচ দেওয়ার জন্য। কারও চোখে ক্লান্তি নেই, আছে কেবল একটাই লক্ষ্য—ভালো ফসল ফলানো।
জমি প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞ
রবিশস্য মৌসুম শুরু হলেই করতোয়া নদীর দুই তীরজুড়ে জমি প্রস্তুতির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কেউ পেঁয়াজের চারা গুঁজছেন, কেউ শাকের খেতে পানি দিচ্ছেন, আবার কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন। কৃষকদের মুখে ঘাম ঝরছে, কিন্তু সেই ঘামেই লুকিয়ে আছে তাঁদের হাসি, তাঁদের আশা।
চুপিনগর গ্রামের কৃষক আবদুল হালিম বলেন,
“এই নদী আমাদের বাঁচায়। করতোয়ার পানি না থাকলে এত ফসল ফলানো যেত না। এখন আমরা রবি মৌসুমে পেঁয়াজ, পালংশাক, মুলা, টমেটো, আর কচুমুখি চাষ করি। ফসল ভালো হলে পরিবারের মুখে হাসি ফোটে।”
রবি মৌসুমে নতুন সম্ভাবনা
বগুড়া অঞ্চলে করতোয়া নদীর পানি ব্যবস্থাপনা কৃষিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। এখন এখানে বছরে তিন থেকে চার মৌসুমে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে। বর্ষার পর জমিতে যখন নদীর পানি কিছুটা নেমে যায়, তখন কৃষকেরা রবি মৌসুমের ফসল রোপণ করেন। এই সময়ের জনপ্রিয় ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে—পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মুগডাল, মুলা, শাকসবজি ও আলু।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান,
“বগুড়া অঞ্চলের কৃষকেরা এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও ফলনশীল ফসল উৎপাদন করছেন। বিশেষ করে করতোয়া নদীর পাড়ে সেচ সুবিধা ভালো হওয়ায় এখানকার উৎপাদন সারাদেশের তুলনায় বেশি।”
শাকসবজির রঙিন খেত
চুপিনগরের মাঠে এখন চোখে পড়ে লাল শাক ও সবুজ পালংশাকের চোখজুড়ানো দৃশ্য। সকালে শিশিরভেজা পাতার ওপর যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতিও যেন কৃষকের শ্রমের প্রশংসা করছে। অনেক কৃষক এখন শাকসবজি চাষকেই প্রধান পেশা বানিয়ে নিয়েছেন। এতে স্বল্প সময়ে লাভও বেশি হয়।
স্থানীয় কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন,
“আগে শুধু ধান করতাম, এখন শাকসবজি চাষে বেশি লাভ হচ্ছে। বাজারে দাম ভালো থাকলে মাসে একবারেই সব খরচ উঠে আসে।”
পাখিরা কৃষকের বন্ধু
করতোয়া নদীর তীরের কৃষিজমিতে দেখা যায় অসংখ্য ফিঙে, দোয়েল, শালিক, চড়ুই। তারা কৃষকের বন্ধু হয়ে পোকামাকড় ধরে ফসল রক্ষা করে। কৃষকেরা বলেন, পাখিরা মাঠে থাকলে বিষের ব্যবহার অনেক কমানো যায়, এতে জমি ও পরিবেশ দুই-ই ভালো থাকে।
নারীরাও এখন কৃষির অংশীদার
চুপিনগর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে এখন নারীরাও কৃষিকাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। তারা বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, ফসল তোলা—সবকিছুতেই অংশ নিচ্ছেন। এতে শুধু পরিবার নয়, পুরো গ্রামের অর্থনীতিতেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।
স্থানীয় এক নারী কৃষক হাসিনা বেগম বলেন,
“আগে শুধু ঘরের কাজ করতাম, এখন জমিতেও কাজ করি। এতে আয় হচ্ছে, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচও দিতে পারি।”
চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম
তবে সবকিছুর পরও কৃষকের জীবনে চ্যালেঞ্জ কম নয়। কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো পণ্যের দাম কমে যাওয়া—এই দুইয়ের মাঝেই টিকে থাকতে হয় তাঁদের। নদীভাঙনও এক বড় সমস্যা। করতোয়ার তীরের অনেক পরিবারই প্রতি বছর নদীর ভাঙনে জমি হারাচ্ছেন।
চুপিনগরের প্রবীণ কৃষক শহীদুল হক বলেন,
“একদিকে নদী আমাদের জীবন দেয়, আবার অন্যদিকে কেড়ে নেয় জমি। নদী যদি রাগ করে, তাহলে কিছুই থাকে না।”
কৃষি প্রযুক্তি ও সরকারী সহায়তা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষকেরা এখন আধুনিক সেচব্যবস্থা, উচ্চফলনশীল বীজ ও জৈব সার ব্যবহার করছেন। এতে উৎপাদন বেড়েছে, খরচ কমেছে। করতোয়ার পাড়ে এখন ছোট ছোট পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হয়, যা আগে ছিল না।
কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান,
“আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি কীভাবে কম পানিতে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ড্রিপ ইরিগেশন, মালচিং এবং জৈব সার ব্যবহারের ওপর এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”
করতোয়ার জলেই কৃষির জীবন
করতোয়া নদী শুধু একটি জলধারা নয়; এটি উত্তরবঙ্গের কৃষি সংস্কৃতির প্রাণ। এ নদীর জলেই শত শত কৃষক তাঁদের স্বপ্ন বুনছেন। সেচের নল টেনে মাঠে নামানো থেকে শুরু করে বিকেলে ঘরে ফেরার সময় পর্যন্ত করতোয়ার বুকে সূর্যের প্রতিফলন যেন তাদের পরিশ্রমের সাক্ষী।
দিন শেষে যখন কৃষকেরা কাজ শেষে বাড়ির পথে পা বাড়ান, তখন করতোয়ার জলে সূর্য ডুবে যায় ধীরে ধীরে। আকাশে মিশে যায় লালচে আলো, নদীর বুকে ভেসে আসে হালকা বাতাস। আর কৃষকের মুখে তখন একটাই তৃপ্তি—আজও তাঁরা তাঁদের জমিতে প্রাণ ঢেলেছেন, আগামীকালও করবেন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই অঞ্চলের কৃষির উন্নয়ন শুধু কৃষকের আয় বাড়ায়নি, বরং স্থানীয় বাজার, পরিবহন খাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসারও উন্নতি ঘটিয়েছে। কৃষিপণ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হাজারো মানুষ করতোয়ার কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
বগুড়া সদরের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন,
“এখানকার ফসল বগুড়া ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকায় যায়। এখন অনেকে করতোয়া পাড়ের সবজি কিনে পাইকারিতে ঢাকায় পাঠায়।”
প্রকৃতি ও কৃষির সহাবস্থান
করতোয়ার পাড়ে এখনো প্রকৃতির শোভা অটুট। চারপাশে সবুজ, দূরে নদীর জল, মাঝে কৃষকের পরিশ্রম—সব মিলিয়ে এটি যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। তবে এই সৌন্দর্য রক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা। প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য ও অতিরিক্ত সার ব্যবহারে নদীর জলদূষণ বাড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে না আনলে কৃষি ও পরিবেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে নদী সংরক্ষণ ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি চালু করলেই এই সৌন্দর্য টিকে থাকবে দীর্ঘদিন।
করতোয়া নদীর তীরে কৃষকের জীবনের এই গল্প শুধু বগুড়ার নয়—এটা বাংলাদেশের কৃষি ও জীবনের প্রতীক। মাটি, পানি আর পরিশ্রমের এই বন্ধনে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। যতদিন কৃষকেরা ভোরে মাঠে নামবেন, ততদিন করতোয়ার বুকে ভাসবে জীবনের গান।
MAH – 13664 I Signalbd.com
