“আজও আমি বিচার পাইনি।”—কণ্ঠে ভারী বেদনা, চোখে অশ্রু, বুকভরা ক্ষোভ। এমনই আর্তনাদ করলেন ফেলানী খাতুনের বাবা মো. নূর ইসলাম, যিনি আজও তার কন্যার হত্যার ন্যায়বিচার পাননি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনের নির্মম মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা তার নিথর দেহ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল, কিন্তু ১৪ বছর পরও বিচার হয়নি—এই বেদনাই যেন আজও জাতির বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
টিজারে আবার ফিরলো সেই ক্ষতচিহ্ন
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রকাশিত দ্বিতীয় টিজারে উঠে এসেছে এই হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মৃতি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ১ মিনিট ৯ সেকেন্ডের টিজারটি প্রকাশ করে। টিজারে দেখা যায়, ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম সীমান্তে কন্যা হত্যার সেই ভয়াল স্মৃতি স্মরণ করে কণ্ঠ ভারী করে বলেন—“আজও আমি বিচার পাইনি। কীভাবে বিচার পাব? তখন আমাদের সরকার ভারতের পক্ষেই কথা বলেছিল। আমরা এমন সরকার চাই না।”
তার এই বক্তব্য যেন কেবল ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, এটি বাংলাদেশের সীমান্তে ঘটে যাওয়া শত শত অমানবিক হত্যার প্রতিধ্বনি।
“আমরা এমন সরকার চাই না”
টিজারে নূর ইসলাম আরও বলেন, “আমরা এমন সরকার চাই না যারা আমাদের পক্ষে কথা বলতে পারে না। আমরা এমন সরকার চাই, যারা হত্যার বিচার চাইবে, সাহসী হবে, আমাদের অধিকার রক্ষায় দাঁড়াবে।”
তার এই বক্তব্যে উঠে আসে সাধারণ মানুষের অন্তর্নিহিত প্রত্যাশা—একটি সরকার, যা নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সামনে ন্যায়বিচারের দাবি তুলতে সাহস দেখাবে।
বিএসএফের গুলিতে নির্মম মৃত্যু
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। ভারতের কুচবিহার সীমান্তে কাঁটাতার টপকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে কিশোরী ফেলানীকে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ফেলানীর দেহ ঝুলে থাকে সীমান্তের কাঁটাতারে—সেই ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক পর্যায়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানালেও, ভারতীয় আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলে ঢিমেতালে। দুই দফায় বিএসএফ সদস্য অমরনাথ নামের এক জওয়ানকে অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ‘নির্দোষ’ ঘোষণা করা হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদ জানালেও, ফলাফল হয়নি। আজও ফেলানীর পরিবারের চোখে তৃপ্তির জল আসেনি।
বিচারহীনতার বেদনা
নূর ইসলাম বহুবার বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেছে, বিচার আসেনি। “আমার মেয়েকে হত্যা করা হলো, কেউ জবাব দিল না। ভারতের আদালত খালাস দিল। বাংলাদেশের সরকারও চুপ রইল। আমরা কি মানুষ না?”—বলেন এই শোকার্ত পিতা।
তার কণ্ঠে বাংলাদেশের সীমান্তবাসীর সেই অব্যক্ত বেদনা ধ্বনিত হয়, যারা প্রতিনিয়ত বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারানোর আতঙ্কে বেঁচে থাকে।
সীমান্তে মৃত্যু যেন নিত্যদিনের সংবাদ
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ১২০০-এরও বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ ঘটনাতেই ভুক্তভোগীরা ছিলেন গরিব সীমান্তবাসী—কেউ দিনমজুর, কেউ কৃষক, কেউ বা ছোটখাটো ব্যবসায়ী।
তবে প্রতিটি মৃত্যুই ফেলানীর মতো একটি পরিবারকে অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে। সীমান্তে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগেরই বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারবার নিন্দা এলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই এই ঘটনাগুলোকে “অবৈধ অনুপ্রবেশ” বলে দায় এড়িয়ে গেছে।
ফেলানী আজও প্রতীকমাত্র নয়, এক প্রতিবাদের নাম
ফেলানী কেবল একটি নাম নয়—সে এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। তার মৃত্যু বাংলাদেশে সীমান্ত নীতির প্রশ্নকে সামনে এনে দিয়েছে। প্রতি বছর ফেলানীর মৃত্যুর দিনটিতে সীমান্তের মানুষ ও মানবাধিকার কর্মীরা তার জন্য প্রার্থনা করে, ন্যায়বিচারের দাবিতে স্লোগান তোলে।
তবে এই দীর্ঘ সময়ে সরকার পরিবর্তন হলেও কোনো সরকার ফেলানীর পরিবারের পাশে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি—এই অভিযোগ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থারও।
নির্বাচনের বার্তা: দেশের চাবি এবার আপনার হাতে
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, টিজারটির শেষাংশে বলা হয়েছে—“ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে ঠিক করুন কেমন বাংলাদেশ চান। মনে রাখবেন, দেশের চাবি এবার আপনার হাতে।”
এই বার্তাটি যেন কেবল নির্বাচনী আহ্বান নয়, বরং একটি প্রশ্ন—আমরা কি এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন, নাকি এমন দেশ যেখানে প্রতিটি প্রাণের মূল্য আছে?
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফেলানী প্রসঙ্গ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই টিজারে ফেলানী হত্যার প্রসঙ্গ তুলে আনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট—জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নে ভোটারদের আবেগে নাড়া দিতে চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচারণা টিম।
একজন সাধারণ পিতার বেদনা রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে না থেকে বরং ন্যায়বিচারের আহ্বান হয়ে উঠুক—এটাই এখন দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফোরামের নির্বাহী পরিচালক আনিসুল হক বলেন, “ফেলানী হত্যার বিচার না হওয়া শুধু তার পরিবারের প্রতি অন্যায় নয়, এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বেরও প্রশ্ন। প্রতিটি সরকারেরই দায় আছে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর।”
তিনি আরও বলেন, “যখন একটি কিশোরীর প্রাণের মূল্যও আন্তর্জাতিক আদালতে স্থান পায় না, তখন আমাদের মানবিক সমাজ হিসেবে আত্মসমালোচনা করা দরকার।”
ফেলানী আমাদের বিবেকের দাগ
ফেলানী আজও বেঁচে আছে সেই সীমান্তের বাতাসে, যেখানে প্রতিনিয়ত বেজে ওঠে বিএসএফের গুলির শব্দ। তার মৃত্যু আমাদের শেখায়—বিচার না পেলে ইতিহাস কখনও ক্ষমা করে না।
তার পিতা নূর ইসলামের সেই সরল উচ্চারণ—“আজও আমি বিচার পাইনি”—শুধু এক পিতার কান্না নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের চেতনায় প্রশ্ন তোলে: আমরা কবে ন্যায়বিচার পাব?
ফেলানীর হত্যার বিচার আজও অধরা। তবুও তার নাম উচ্চারিত হয় প্রতিবাদে, মোমবাতির আলোয়, মানবতার প্রার্থনায়। আজও যখন তার বাবা টিজারে কণ্ঠে বেদনা ভরে বলেন, “আমরা এমন সরকার চাই না”, তখন সেটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং একটি জাতির নৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন।
এই নির্বাচন, এই সময়, এই দেশ—সবকিছুই যেন এক প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে: আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই? যেখানে ফেলানীর মতো মেয়েরা নিরাপদ থাকবে, নাকি যেখানে ন্যায়বিচার কেবল স্বপ্ন হয়েই থাকবে?
MAH – 13663 I Signalbd.com



