বিশ্ব

তুরস্কে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

Advertisement

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে তুরস্ক। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক অভিযানে হাজারো নিরীহ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর ঘটনার পর দেশটির বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়।

গণহত্যার অভিযোগে কঠোর অবস্থানে তুরস্ক

শুক্রবার (৭ নভেম্বর) তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের শীর্ষ সরকারি কৌঁসুলির দপ্তর থেকে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এই পরোয়ানায় শুধু প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নয়, তার সরকারের আরও ৩৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ত্রাণবাহী বহর আটকে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা।

যেসব ইসরায়েলি কর্মকর্তার নামে পরোয়ানা

পরোয়ানায় অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গিভর, এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়া’আল জামির

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—গাজায় পরিকল্পিতভাবে বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের নামে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালানো, হাসপাতাল ও ত্রাণকেন্দ্রে আক্রমণ, এবং শিশু ও নারীদের লক্ষ্য করে হামলা করা।

গাজা উপত্যকার ভয়াবহ চিত্র

গত বছরের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হয়। এর পর থেকে প্রাণ হারিয়েছে ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

গাজার হাসপাতাল, স্কুল, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির পর্যন্ত বোমাবর্ষণের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এসব হামলাকে “সম্ভাব্য গণহত্যা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

তুরস্ক শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে আসছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বহুবার বলেছেন, “ইসরায়েলের এই হামলা শুধু যুদ্ধ নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”

ইসরায়েলের তীব্র প্রতিক্রিয়া

তুরস্কের এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সা’র এক বিবৃতিতে বলেন,
“এটি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রচারণা ছাড়া কিছু নয়। তিনি তুরস্কের বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।”

ইসরায়েল আরও দাবি করেছে, গাজায় তারা শুধু হামাসের সামরিক ঘাঁটি ও অস্ত্রভান্ডার লক্ষ্য করছে, বেসামরিক জনগণকে নয়। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রকাশিত ভিডিও ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, অসংখ্য আবাসিক ভবন, হাসপাতাল ও স্কুল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

তুরস্কের অবস্থান আন্তর্জাতিক আদালতে

উল্লেখ্য, গাজায় গণহত্যার অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা গত বছর আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)-এ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার বাদিপক্ষ হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে।

এর আগে তুরস্ক ২০১০ সালে গাজাগামী ত্রাণবাহী জাহাজ “মাভি মারমারা”-তে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায়ও প্রতিবাদ জানিয়ে আদালতে গিয়েছিল। সেই ঘটনার রেশ এখনও তুর্কি জনগণের মনে গভীরভাবে রয়ে গেছে।

হামাসের প্রতিক্রিয়া: তুরস্ককে অভিনন্দন

গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাস তুরস্কের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে,
“তুরস্কের জনগণ ও নেতৃত্বের এই সাহসী অবস্থান প্রমাণ করে, মানবতার পক্ষে এখনো কিছু দেশ নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে আছে।”

তারা আরও বলে, “গাজায় যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্কের টানাপোড়েন

গত কয়েক বছরে তুরস্ক ও ইসরায়েলের সম্পর্ক নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২২ সালে দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দিলেও গাজায় নতুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সম্পর্ক আবারো তিক্ত হয়ে পড়ে।

তুরস্ক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়, এবং নিজেদের রাষ্ট্রদূতকেও তেলআবিব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। পাশাপাশি, ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের ডাক দেয় তুরস্কের বেসরকারি সংগঠনগুলো।

বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন প্রভাব

তুরস্কের এই পদক্ষেপ শুধু একটি আইনি ঘটনা নয়—এটি মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার মধ্যে তুরস্কের এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হতে পারে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে তুরস্কের পদক্ষেপকে “অতিমাত্রায় রাজনৈতিক” বলে মন্তব্য করেছেন। তবে জাতিসংঘের কয়েকজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “তুরস্কের এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, গাজায় সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার অবশেষে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, “যে কোনো রাষ্ট্রের বিচারিক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় হতে হবে।”

অন্যদিকে, কাতার, ইরান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তুরস্কের এই সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন,
“যেখানে শিশুদের কবর দিতে হয় প্রতিদিন, সেখানে ন্যায়বিচারের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ প্রশংসনীয়।”

এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইতোমধ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করছে। যদি আদালত তুরস্কের পরোয়ানাকে স্বীকৃতি দেয়, তবে নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সীমিত হয়ে পড়বে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি: ভঙ্গুর শান্তি

বর্তমানে গাজায় একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চলছে। তবে পরিস্থিতি এখনো উত্তপ্ত। ত্রাণবাহী সংস্থাগুলো বলছে, খাদ্য ও ওষুধের অভাবে গাজার মানুষের জীবন চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তুরস্কের এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গাজার জনগণের নৈতিক সমর্থন জোগাবে এবং আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়াবে।

তুরস্কের এই সাহসী পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গাজায় রক্তপাত বন্ধে এটি এক শক্ত বার্তা—যে, যুদ্ধের নামে মানবতার হত্যাযজ্ঞ আর সহ্য করা হবে না

যদিও ইসরায়েল এই পরোয়ানাকে “রাজনৈতিক নাটক” বলছে, তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন—এটি ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

গাজায় শান্তি ফিরে আসুক, মানবতার জয় হোক—এই প্রত্যাশাই এখন সবার।

MAH – 13661 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button