যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চললেও সীমান্তে উত্তেজনা বজায়, রাজনৈতিক আলোচনায় রাজি নয় হিজবুল্লাহ
লেবাননের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনায় বসবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যস্থতায় আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব এলেও হিজবুল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—তারা এমন কোনো আলোচনায় যাবে না যা তাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
হিজবুল্লাহর অবস্থান: “আলোচনা নয়, প্রতিরোধই পথ”
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ জানায়, ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা তাদের বৈধ অধিকার, এবং তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লেবাননের সেনাবাহিনীর পাশে রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা আমাদের দেশ, সেনাবাহিনী ও জনগণের পাশে আছি। আমাদের ওপর অত্যাচার হলে সেটি প্রতিরোধ করা আমাদের বৈধ অধিকার।”
গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক দপ্তরের এক সিনিয়র নেতা বলেন, “ইসরাইল আমাদের ভূমি দখল করে রেখেছে এবং সীমান্তে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো আলোচনা হতে পারে না।”
যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যস্থতায় আলোচনার প্রস্তাব
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও মিসর লেবানন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছিল। ওয়াশিংটন মনে করে, আলোচনাই উত্তেজনা কমানোর একমাত্র উপায়।
তবে হিজবুল্লাহ বলেছে, “যে দেশগুলো ইসরাইলের দখলদারিত্বকে সমর্থন দেয়, তাদের মধ্যস্থতায় কোনো সংলাপই কার্যকর হবে না।” গোষ্ঠীটির মতে, আলোচনার নামে লেবাননের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার সুযোগ নেই।
সীমান্তে উত্তেজনা ও যুদ্ধবিরতির বাস্তবতা
২০২৪ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনা বন্ধ হয়নি। দক্ষিণ লেবাননের বেশ কয়েকটি এলাকায় নিয়মিত ড্রোন হামলা ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটছে।
গত সপ্তাহে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে লেবাননের এক পৌর কর্মচারী নিহত হন। এ ঘটনার পর লেবাননে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
হিজবুল্লাহর ঐতিহাসিক অবস্থান ও অস্ত্রধারণ
লেবাননের ১৯৭৫–১৯৯০ সালের গৃহযুদ্ধের পর সকল গোষ্ঠী অস্ত্র সমর্পণ করলেও হিজবুল্লাহ তা করেনি। তারা দাবি করে, ইসরাইলের দখলকৃত এলাকা মুক্ত করা এবং লেবাননের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের দায়িত্ব।
ইরানের সমর্থনপুষ্ট এই গোষ্ঠীটি দেশের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। হিজবুল্লাহর নেতারা সবসময়ই বলেছেন, তাদের অস্ত্র দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রয়োজনীয়।
লেবাননের রাজনৈতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন
লেবাননের অভ্যন্তরে হিজবুল্লাহর অবস্থান নিয়ে বিভাজন দেখা গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, গোষ্ঠীটির অস্ত্রধারণ দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখছে, অন্যদিকে অনেকে বলেন এটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে একধরনের ‘রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র’ তৈরি করেছে।
লেবাননের সরকার সম্প্রতি জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণে দক্ষিণ সীমান্তে নতুন নিরাপত্তা বৈঠকের প্রস্তাব পেয়েছে। তবে হিজবুল্লাহর স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানের কারণে এ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে।
ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হিজবুল্লাহ যদি অস্ত্রশস্ত্র পুনর্গঠনের চেষ্টা করে, তবে ইসরাইল ‘কঠোর জবাব’ দেবে। তিনি বলেন, “আমরা লেবাননের সীমান্তে শান্তি চাই, কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা দরকার, তা করব।”
ইসরাইলি সামরিক সূত্র জানায়, দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি এলাকায় সেনা মোতায়েন বাড়ানো হয়েছে এবং নজরদারি ড্রোন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন অধ্যায়
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হিজবুল্লাহর এই ঘোষণার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পরোক্ষ সংঘাতের প্রভাব এখন সরাসরি লেবানন সীমান্তে দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, “হিজবুল্লাহর আলোচনা প্রত্যাখ্যান কেবল ইসরাইল নয়, পশ্চিমা শক্তিগুলোকেও বিব্রত করেছে। এটি একদিকে জাতীয় অবস্থানের ঘোষণা, অন্যদিকে আঞ্চলিক ভারসাম্যে নতুন সংকটের ইঙ্গিত।”
ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে হিজবুল্লাহ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—তারা এখনো প্রতিরোধের নীতিতে অনড়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা সত্ত্বেও সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় লেবানন অঞ্চলে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেও বাস্তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
এম আর এম – ২১১৮,Signalbd.com



