প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’ চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এই নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে গুম বা জোরপূর্বক লাপাত্তা করার অপরাধকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
শফিকুল আলম বলেন, “গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে বহুদিন ধরে আইন প্রণয়নের জন্য আলোচনা চলছিল। আজকে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এই অধ্যাদেশে গুমকে সংজ্ঞায়িত করার পাশাপাশি চলমান অপরাধ, পুনরাবৃত্তি (কন্টিনিউ অফেন্স) হিসেবে বিবেচনা করে কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
গোপন আটক কেন্দ্র ‘আয়নাঘর’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা
প্রেস সচিব শফিকুল আলম আরও জানান, গোপন আটক কেন্দ্র স্থাপন, বিশেষ করে যাকে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেশের কোনো স্থানেই ভবিষ্যতে এমন কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না এবং যারা এই অপরাধ সংঘটিত করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গুম সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তের ক্ষমতা কমিশনকে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালগুলিতে অভিযোগ গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর অধিকার রক্ষা, ক্ষতিপূরণ এবং আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করার জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য নতুন বিধান
নতুন অধ্যাদেশে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
- দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ: অভিযোগ গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
- ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষা: ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর নিরাপত্তা এবং আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা হবে।
- ক্ষতিপূরণ: যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত হবে।
- তহবিল ও তথ্যভাণ্ডার: গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন এবং তথ্যভাণ্ডার স্থাপন।
শফিকুল আলম বলেন, “আজকের বৈঠকে জাতীয় লজিস্টিক নীতির খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। জাতীয় নগরনীতি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে, তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া ২০২৬ সালের সরকারি ছুটির তালিকাও অনুমোদিত হয়েছে।”
বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহ ইতিহাস
প্রেস সচিব আরও বলেন, “শেখ হাসিনার সরকারের সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। গুম বিষয়ক কমিশনে প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার, যদিও কমিশন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এটি ৪০০ এরও বেশি হতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা শতাধিক ‘আয়নাঘর’ ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকেই ফিরে এসেছেন, তবে অনেকে এখনও নিখোঁজ।”
তিনি উল্লেখ করেন, “বিএনপির অনেক কর্মী এখনো দেশে ফিরে আসেননি। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।”
আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে আইন প্রণয়ন
শফিকুল আলম জানিয়েছেন, “গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি, ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ অনুযায়ী অধ্যাদেশটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ গত বছর ২৯ আগস্ট এই চুক্তিতে অংশীদার হয়েছে। এর ফলে দেশের আইন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সমন্বিত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক আইন। এখন থেকে দেশে কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার গুমের রাজত্ব চালাতে পারবে না। আর কোনো ‘আয়নাঘর’ স্থাপন করা যাবে না।”
নিরাপদ ও স্বচ্ছ সমাজ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য
এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশের মানবাধিকার সংরক্ষণে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। গুম প্রতিরোধ, ভুক্তভোগীর সুরক্ষা, দ্রুত বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষা করা সম্ভব হবে।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যে কেউই ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে নিখোঁজ হবে না। এটি দেশের আইন শৃঙ্খলা, মানবাধিকার এবং বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫ চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতিহাসে এক নতুন আইনগত মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এই আইন দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা, গোপনীয় নিখোঁজ প্রতিরোধ, এবং মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া, এই আইন আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারের স্পষ্ট বার্তা হলো, গুম, নিখোঁজ এবং অমানবিক কার্যকলাপের জন্য দেশে কোনো স্থান নেই।
MAH – 13660 I Signalbd.com



