বাংলাদেশ

আমতলীতে ৯ লাখ টাকার জাটকা জব্দ, এতিমখানা ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ

Advertisement

বরগুনার আমতলীতে ৯ লাখ টাকার প্রায় ১,৫০০ কেজি জাটকা ইলিশ জব্দ করেছে যৌথ বাহিনী। জব্দ করা এসব মাছ পরে এতিমখানা ও গরিব-দুঃস্থ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আমতলী উপজেলার ছুরিকাটা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ জাটকা জব্দ করা হয়। এ সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা কুয়াকাটা থেকে ঢাকাগামী তিনটি বাস আটক করেন, যেখানে মাছগুলো পাচার করা হচ্ছিল বলে জানা যায়।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান

আমতলী উপজেলা প্রশাসন ও যৌথ বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, কুয়াকাটা থেকে ঢাকাগামী ভাই ভাই, সোহেল, এবং সুবহা-সুরহা পরিবহনের তিনটি বাসে গোপনে জাটকা বহন করা হচ্ছিল।

গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নৌবাহিনীর আমতলী নৌকন্টিনজেন্ট কমান্ডার লে. নকিব নসরুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে উপস্থিত ছিলেন আমতলী থানার পুলিশ সদস্যরাউপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা

অভিযানের সময় ছুরিকাটা নামক স্থানে তিনটি বাস থামিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। এতে ৯ লাখ টাকা মূল্যের প্রায় ১,৫০০ কেজি জাটকা ইলিশ জব্দ করা হয়।

জব্দকৃত মাছ এতিমখানা ও গরিবদের মাঝে বিতরণ

জব্দকৃত মাছগুলো পরে আমতলী থানায় নিয়ে আসা হয়। উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মাছগুলো স্থানীয় এতিমখানা, মাদরাসা ও গরিব মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রশাসনের এমন উদ্যোগে তারা খুশি। কারণ এসব জাটকা বাজারে বিক্রি হলে ইলিশের প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতো।

জাটকা সংরক্ষণে সরকারের কঠোরতা

বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর জাটকা সংরক্ষণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে থাকে। জাটকা ধরা, পরিবহন, মজুত ও বিক্রয়—সবই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

বাংলাদেশ মৎস্য আইন ১৯৫০ (সংশোধিত) অনুযায়ী, প্রতি বছর মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন এবং অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত সাত মাসের জন্য জাটকা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।

এই সময়ে উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ টহল জোরদার করা হয়। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, মৎস্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে থাকে।

নৌবাহিনীর কর্মকর্তার বক্তব্য

অভিযানের নেতৃত্বদানকারী লে. নকিব নসরুল্লাহ বলেন,

“আমাদের নিয়মিত টহল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করি। আমরা তিনটি বাস থেকে বিপুল পরিমাণ জাটকা জব্দ করেছি। ইলিশের প্রজনন রক্ষায় আমাদের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

তিনি আরও বলেন,

“দেশের অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান বিশাল। তাই এর বংশবৃদ্ধি রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।”

ইলিশ সংরক্ষণে সরকার ও জনগণের ভূমিকা

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশই হয় বাংলাদেশে।

সরকার প্রতিবছর জাটকা সংরক্ষণে হাজার হাজার জেলে পরিবারকে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়, যাতে তারা নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরায় না যায়। এছাড়া, বরাদ্দ দেওয়া হয় ভিজিএফ (VGF) কর্মসূচির আওতায় চাল ও আর্থিক সহায়তা।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে সারাদেশে প্রায় ৩৫ হাজার কেজি জাটকা জব্দ করা হয়েছে এবং ১৫০ জনের বেশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

ইলিশ রক্ষায় জেলেদের সচেতনতা বাড়ছে

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এখন জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। আগের তুলনায় এখন জাটকা ধরার প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তবুও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও দালাল চক্র গোপনে জাটকা পাচার করছে।

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, “যেখানে সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ একসাথে হয়েছে, সেখানেই জাটকা ধরা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।”

ইলিশের প্রজনন মৌসুমে বিশেষ অভিযান

প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল ও অক্টোবর-নভেম্বরে নদ-নদীতে টহল বাড়ানো হয়। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, বিষখালী, পায়রা ও কুয়াকাটা উপকূলে অভিযান পরিচালনা করে যৌথ বাহিনী।

২০২৫ সালেও সেই ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান চলছে। বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুরসহ ১১টি জেলায় জাটকা ধরায় কঠোর নজরদারি চলছে।

ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু রুচিরই নয়, অর্থনীতিরও গর্ব।
ইলিশ খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসে। প্রায় ২৫ লাখ মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ইলিশ নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে।

কিন্তু জাটকা নিধন এই বিশাল অর্থনৈতিক খাতকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এক কেজি জাটকা বড় হলে সেটি চারগুণ বেশি বাজারমূল্যের ইলিশে পরিণত হতে পারত।”

সচেতন নাগরিকদের প্রশংসা

স্থানীয় সচেতন নাগরিক ও শিক্ষক সমাজ এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “যারা গোপনে জাটকা পাচার করছে, তারা শুধু আইন ভাঙছে না—তারা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে।”

তাদের দাবি, “জাটকা রক্ষা অভিযানে আরও স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় তরুণদের যুক্ত করা উচিত, যাতে গোয়েন্দা তথ্য আরও দ্রুত পাওয়া যায়।”

জাটকা রক্ষা, জাতির দায়িত্ব

আমতলীতে ৯ লাখ টাকার জাটকা জব্দের ঘটনাটি শুধু একটি অভিযান নয়—এটি একটি বার্তা। এই বার্তা হলো, ইলিশ রক্ষায় সরকার, প্রশাসন ও জনগণ সবাই একসাথে কাজ করছে।

যত বেশি অভিযান হবে, তত বেশি জাটকা রক্ষা পাবে, ততই সমৃদ্ধ হবে দেশের ইলিশ ভান্ডার।
একটি বড় ইলিশের জন্ম হয় তখনই, যখন একটি ছোট জাটকাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

MAH – 13658 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button