বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের কৃষি আজ হয়ে উঠছে আধুনিক, উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিনির্ভর। সেই পরিবর্তনের অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ হয়ে উঠেছেন লক্ষ্মীপুরের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আবদুর রহমান সোহাগ। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি চাষ করেছেন নতুন ১২ জাতের ধান, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি জাত ইতিমধ্যেই আলোচনায় এসেছে সারা দেশে।
আধুনিক কৃষির পথে সোহাগের যাত্রা
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের নলডগী গ্রামের ইব্রাহীম খলিলের ছেলে সোহাগ। তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অল্প বয়সেই কৃষির প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মে তার। আট বছর ধরে তিনি কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। শুরুতে পরিবারের জমিতে ধান ও শাকসবজি চাষ করলেও এখন তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনী কৃষির পথে হেঁটেছেন।
ধানের পাশাপাশি তিনি সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষা, তিল, ক্যাপসিকাম ও চূড়াইফলসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করছেন। তার কৃষি উদ্যোগ এখন অন্য কৃষকদের জন্যও এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
নতুন ১২ জাতের ধান চাষে সফলতা
সোহাগ এ বছর চাষ করেছেন মোট ১২টি নতুন জাতের ধান, যার মধ্যে তিনটি একেবারে নতুন—
ব্রি ধান-১১২, ব্রি ধান-১১৩, এবং ব্রি ধান-১১৪।
এই তিনটি জাত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত। জুন ২০২৫-এ জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি) আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলোর অনুমোদন দেয়।
- ব্রি ধান-১১২: মাঝারি মেয়াদি রোপা আমন মৌসুমের জন্য উপযোগী। লবণাক্ত জমিতেও ভালো ফলন দেয়।
- ব্রি ধান-১১৩: বোরো মৌসুমের জন্য উদ্ভাবিত। এটি জনপ্রিয় ব্রি ধান-২৯ এর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
- ব্রি ধান-১১৪: এটি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এবং দীর্ঘস্থায়ী বোরো জাত। যেসব এলাকায় ব্লাস্ট রোগে ফলন কমে যায়, সেখানে এই জাত দারুণ সাড়া দিচ্ছে।
সোহাগ দুই একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে এই তিনটি নতুন জাত চাষ করেন। ফলনও আশানুরূপ ভালো হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা তার মাঠ পরিদর্শন করে ফলনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বিগত মৌসুমের সফল জাতগুলো
এর আগে ২০২৪ সালের বোরো মৌসুমে সোহাগ চাষ করেছিলেন আরও কয়েকটি নতুন জাত—
ব্রি ধান-১০০, ১০১, ১০২, ১০৪, ১০৫, ১০৭ ও ১০৮।
এর মধ্যে ব্রি ধান-১০৫ বিশেষভাবে আলোচনায় আসে, কারণ এটি “ডায়াবেটিস ধান” নামে পরিচিত। এর চাল খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ব্রি ধান-১০০ জাতটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ, যা পুষ্টিগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া আউশ মৌসুমে তিনি চাষ করেছেন ব্রি ধান-৯৮, আর আমন মৌসুমে ব্রি ধান-১০৩, ৮৭, ৯৪ ও ৯৫।
এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ব্রি ধান-১০৮, যার বীজ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকরা সংগ্রহ করেছেন।
বাংলাদেশে মোট ১২১টি ব্রি ধানের জাত
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এখন পর্যন্ত মোট ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ৮টি হাইব্রিড জাত। প্রতিটি জাতের লক্ষ্য—ফলন বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ এবং জলবায়ু সহনশীলতা।
এই নতুন জাতগুলোর মধ্যে কিছু বিশেষভাবে লবণাক্ততা সহনশীল, কিছু খরা সহনশীল, আবার কিছু রোগ প্রতিরোধী ও পুষ্টিকর।
সোহাগের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা
২০১৯ সাল থেকে কৃষিতে যুক্ত সোহাগ বলেন,
“আমি শুরুতে শুধু ধান চাষ করতাম। পরে নতুন জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করি। এখন প্রতি মৌসুমে নতুন জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করি। ফলন ভালো হওয়ায় আমার অনুপ্রেরণা আরও বেড়েছে।”
তিনি আরও জানান, আগামী মৌসুমে তিনি এসব নতুন জাতের বীজ সারাদেশে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান, যেন আরও বেশি কৃষক উপকৃত হতে পারেন।
তদারকি ও সহায়তায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাসান ইমাম বলেন,
“সোহাগ একজন উদ্যমী ও আদর্শ কৃষক। ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলো আমরা তার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করাচ্ছি। আমরা নিয়মিত তদারকি করি, প্রশিক্ষণ দিই এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করি।”
তিনি জানান, সোহাগের চাষ করা নতুন জাতগুলোতে ফলন ভালো হওয়ায় অনেক কৃষক এখন তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন এবং একই জাতের ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
গ্রামীণ কৃষকদের পরিবর্তন
স্থানীয় কৃষক আবদুস শহীদ বলেন,
“আমরা আগে প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান চাষ করতাম। কিন্তু ফলন কম হত। সোহাগের কাছ থেকে শিখে নতুন জাতের ধান চাষ শুরু করেছি। এখন আমরা আগের তুলনায় অনেক ভালো ফলন পাচ্ছি।”
তিনি জানান, বর্তমানে তাদের এলাকায় শতাধিক কৃষক নতুন জাতের ধান চাষ করছেন। এতে শুধু ফলনই বাড়ছে না, কৃষকদের আয়ও দ্বিগুণ হচ্ছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূমিকা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন,
“আমরা নিয়মিতভাবে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য—জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এমন জাত তৈরি করা, যা বেশি ফলন দেবে, রোগ প্রতিরোধী হবে এবং কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাবে।”
তিনি আরও বলেন,
“সোহাগের মতো তরুণ উদ্যোক্তারা আমাদের গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন। তাদের হাতে বাংলাদেশের কৃষি আরও সমৃদ্ধ হবে।”
কৃষি উদ্ভাবনে তরুণদের ভূমিকা
বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক তরুণ কৃষির দিকে ঝুঁকছেন। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় তারা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। সোহাগের মতো উদ্যোক্তারা প্রমাণ করছেন, কৃষি এখন শুধু জীবিকা নয়, এটি লাভজনক পেশা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র।
লক্ষ্মীপুরে কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনা
সোহাগের ধানক্ষেত এখন স্থানীয় পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নতুন জাতের ধানের মাঠ দেখতে আসছেন অনেকে। ফলে কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে এলাকায়।
স্থানীয় কৃষিবিদরা বলছেন, এ ধরনের কৃষি উদ্ভাবন শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও বড় ভূমিকা রাখবে।
সোহাগের স্বপ্ন
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে সোহাগ বলেন,
“আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষক যেন নতুন জাতের ধান চাষে এগিয়ে আসে। আমি নিজেও বড় পরিসরে বীজ উৎপাদন ও বিপণন করতে চাই, যাতে কৃষকরা সহজে বীজ পায় এবং খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আরও স্বনির্ভর হয়।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, সরকারি সহযোগিতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হবে আধুনিক কৃষির এক সফল উদাহরণ।
বাংলাদেশের কৃষি আজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি, গবেষণা ও তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের ফলে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন আত্মনির্ভর।
লক্ষ্মীপুরের তরুণ সোহাগের মতো উদ্যোক্তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন—যদি ইচ্ছা, পরিশ্রম ও জ্ঞান একসঙ্গে প্রয়োগ করা যায়, তবে কৃষিও হতে পারে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পেশা।
তার হাতে শুরু হওয়া এই পরিবর্তনই হতে পারে বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের নতুন অধ্যায়।
MAH – 13646 I Signalbd.com