মার্কিন রাজনীতিতে আবারও তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার তিনি অভিযোগ করেছেন, নিউইয়র্ক সিটি যখন জোহরান মামদানিকে মেয়র নির্বাচিত করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে’। ট্রাম্পের মতে, এটি শুধু একটি স্থানীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং আমেরিকার আদর্শ ও জাতীয় পরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, বুধবার ফ্লোরিডার মায়ামিতে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “নিউইয়র্ক সিটি এখন কমিউনিস্ট শাসনের দিকে যাচ্ছে। এটি আমাদের জাতির জন্য এক সতর্ক সংকেত।”
‘আমরা এটি সামলে নেবো’ — ট্রাম্পের ঘোষণা
ভাষণের এক পর্যায়ে ট্রাম্প বলেন, “আমরা এটি সামলে নেবো। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এখন বুঝে গেছে কে তাদের দেশের প্রকৃত বন্ধু, আর কে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।” যদিও তিনি মামদানি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করেননি, তবু তার বক্তব্য স্পষ্টভাবেই বোঝায় যে, তিনি নিউইয়র্কের নতুন নেতৃত্বকে ‘চরম বামপন্থী’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
ট্রাম্প বলেন, “নিউইয়র্ক এখন এমন এক পথে হাঁটছে, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান মূল্যবোধ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফ্লোরিডা এখন আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে সেইসব মানুষের জন্য, যারা নিউইয়র্কের বামপন্থা থেকে পালাতে চাইবে।”
নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানি কে?
জোহরান মামদানি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন রাজনীতিক, যিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠেছেন। তিনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকার (DSA) সদস্য এবং দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসী অধিকার, আবাসন সংকট, ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
মামদানি প্রথমে নিউইয়র্ক রাজ্যের আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। পরে শহরের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেন। তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীল ভোটারদের মধ্য থেকে তিনি ব্যাপক সমর্থন পান।
তবে রিপাবলিকান এবং রক্ষণশীল মহলে তার অবস্থান বিতর্কিত। অনেকেই মনে করেন, মামদানি মার্কিন অর্থনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে ‘অতি-বামপন্থী’ দৃষ্টিভঙ্গি আনতে পারেন, যা ট্রাম্পের মতো নেতাদের মতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি’।
ট্রাম্পের বক্তব্যে নতুন বিতর্ক
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বরাবরই বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য পরিচিত। নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের পর তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আবারও আমেরিকার বিভক্ত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে এনেছে।
ট্রাম্প বলেন, “আমেরিকার জনগণকে এখন দুটি পথের একটিকে বেছে নিতে হবে — তারা চাইলে কমিউনিজমের পথে যেতে পারে, অথবা সাধারণ জ্ঞানের পথে থাকতে পারে। আমাদের সামনে এখন অর্থনৈতিক দুঃস্বপ্ন ও সাফল্যের বিস্ময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন রয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা নিউইয়র্ককে সফল করতে চাই। আমরা মামদানিকে সাহায্য করব, হয়তো কিছুটা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আত্মা কখনো বিক্রি হতে পারে না।”
‘সার্বভৌমত্ব হারানো’র অর্থ কী?
ট্রাম্পের এই বক্তব্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন — যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ‘সার্বভৌমত্ব হারাতে পারে’? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প মূলত প্রতীকী অর্থে এই কথাটি বলেছেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি — যেমন পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পরিবর্তে যদি সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে গ্রহণ করে, তবে সেটিই হবে এক ধরনের “সার্বভৌমত্ব হারানো।”
ওয়াশিংটনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক লরেন্স মিলার বলেন, “ট্রাম্পের বক্তব্য আসলে একধরনের রাজনৈতিক কৌশল। তিনি বামপন্থী প্রার্থীদের ‘কমিউনিস্ট’ বলে চিহ্নিত করে নিজের সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখছেন।”
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের ভাষণ
ট্রাম্পের এই বক্তব্যটি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র আবারও নির্বাচনী উত্তেজনায় ভরপুর। ২০২৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচন সামনে রেখে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ব্যস্ত।
গত বছরের ৪ নভেম্বর ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বার্ষিকী উপলক্ষে বলেন, “আমরা আমাদের অর্থনীতি উদ্ধার করেছি, আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছি, এবং একসাথে সেই দুর্দান্ত রাতে আমাদের দেশকে রক্ষা করেছি।”
তার এই ভাষণকে অনেকেই তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
ফ্লোরিডা বনাম নিউইয়র্ক: দুটি আমেরিকার প্রতিচ্ছবি
ট্রাম্প ফ্লোরিডা রাজ্যকে এখন “স্বাধীন আমেরিকার প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরছেন। সেখানে রিপাবলিকান শাসনে ব্যবসা-বাণিজ্য, করনীতি ও সামাজিক রক্ষণশীলতা শক্তিশালী হয়েছে বলে দাবি তার। অন্যদিকে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্যগুলোকে তিনি “বামপন্থী পরীক্ষাগার” বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, “ফ্লোরিডা হলো সেই রাজ্য যেখানে মানুষ নিরাপদ বোধ করে, ব্যবসা বৃদ্ধি পায়, এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু নিউইয়র্ক এখন এমন এক জায়গা হয়ে উঠেছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে।”
এই বক্তব্য আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিভাজনের প্রতিফলন — যেখানে দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে রক্ষণশীল দক্ষিণ ও প্রগতিশীল উত্তর।
মামদানির প্রতিক্রিয়া: ‘এটি জনগণের জয়’
এদিকে নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানি ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতি সরাসরি প্রতিক্রিয়া না জানালেও, তার অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “নিউইয়র্কের মানুষ একটি ঐক্যবদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর গড়তে চায়। এটি কারো বিরুদ্ধে নয়, বরং সবার জন্য।”
মামদানি আরও বলেন, “আমরা এমন একটি শহর চাই যেখানে সবাই নিরাপদ, সাশ্রয়ী বাসস্থান পায়, এবং সুযোগের সমান অধিকার ভোগ করে।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মামদানি তার প্রচারণার শুরু থেকেই ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছেন। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মূল ছিল — আবাসন সংকট মোকাবিলা, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের এই বক্তব্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ট্রাম্পের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়েও ট্রাম্পের বক্তব্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তিনি বলেছেন, “আমরা ইসরায়েলকে সমর্থন করব, তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথমে জয়ী হতে হবে।”
বিশ্লেষণ: ট্রাম্পের ভাষণে রাজনৈতিক ইঙ্গিত
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্প এই বক্তব্যের মাধ্যমে দুটি লক্ষ্য পূরণ করতে চান —
প্রথমত, নিজের সমর্থক রিপাবলিকান ভোটারদের একত্রিত করা;
দ্বিতীয়ত, ডেমোক্র্যাট দলের বামপন্থী অংশকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা।
বিশ্লেষক সারা রিচার্ডসন বলেন, “ট্রাম্পের ভাষণগুলো সবসময় নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখা উচিত। তিনি জানেন, এমন মন্তব্য করলে মিডিয়া তুমুল আলোচনায় রাখবে, যা তার রাজনৈতিক লাভে আসে।”
ট্রাম্পের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আবারও সামনে এনেছে — যেখানে দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত: একদিকে প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটরা, অন্যদিকে রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা।
নিউইয়র্কে জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচিত হওয়া হয়তো শহরের জন্য এক নতুন অধ্যায়, তবে ট্রাম্পের চোখে এটি “আমেরিকার দিক হারানো”-র প্রতীক।
আগামী নির্বাচনে এই বিতর্ক কতটা প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত — ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনকে নাড়া দিয়েছেন, এবং তার প্রতিটি মন্তব্য এখনো গণমাধ্যমে ঝড় তুলতে সক্ষম।
MAH – 13645 I Signalbd.com



