বাংলাদেশে শীতের আগমন ধীরে ধীরে শুরু হতে যাচ্ছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে এবারও শুরু হচ্ছে শীতের যাত্রা। আবহাওয়াবিদদের মতে, আগামী ১০ নভেম্বরের পর থেকেই উত্তরাঞ্চলে ঠান্ডা হাওয়ার প্রভাব বাড়তে শুরু করবে, আর নভেম্বরের শেষ দিকে সারা দেশেই শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (BWOT) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ দেখা যেতে পারে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে।
শীত আসছে ধীরে ধীরে: উত্তরাঞ্চল থেকে ছড়াবে সারাদেশে
বাংলাদেশের শীত সাধারণত উত্তরাঞ্চল থেকেই শুরু হয়। রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী—এই জেলাগুলিতে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই রাতের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে।
বিডব্লিউওটি’র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বছর উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা ১০ নভেম্বরের পর থেকে কমতে শুরু করবে, এবং নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলেও শীতের ছোঁয়া পাওয়া যাবে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে বর্তমানে বড় কোনো লঘুচাপ নেই, ফলে বৃষ্টির সম্ভাবনা কমে গেছে। এর ফলে বাতাসের আর্দ্রতা হ্রাস পাচ্ছে এবং শুষ্ক ও ঠান্ডা হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় শীতের সূচনা দ্রুত হচ্ছে।
কৃষকদের জন্য সুসংবাদ: আবহাওয়া অনুকূলে থাকবে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত
বিডব্লিউওটি জানিয়েছে, আগামী ৮ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে আবহাওয়া অনুকূলে থাকবে। এই সময়টিকে কৃষিকাজের জন্য আদর্শ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ধান কাটা, শীতকালীন সবজি রোপণ, আলু, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও মসুর চাষের জন্য এই সময়টি খুবই উপযুক্ত বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
কৃষিবিদরা বলছেন, এ বছর মৌসুমের শুরুতে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাই নভেম্বরের এই অনুকূল আবহাওয়া কৃষকদের নতুন আশার আলো জোগাবে।
বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব কম, তবে বিচ্ছিন্ন বৃষ্টি হতে পারে
বিডব্লিউওটি’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, লঘুচাপের প্রভাব কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাত অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। আগামী ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের কিছু কিছু স্থানে সামান্য বৃষ্টি হতে পারে, তবে তা বিচ্ছিন্ন ও স্বল্পস্থায়ী হবে।
তারা আরও জানিয়েছে, ২০ নভেম্বরের আগে দেশে বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। তবে ১৭-১৮ নভেম্বরের দিকে চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু এলাকায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “এখন থেকে ধীরে ধীরে বাতাসের গতি পরিবর্তন হবে। দক্ষিণ দিকের আর্দ্রতা কমে উত্তর দিকের শুষ্ক হাওয়া প্রবাহিত হবে। এটাই শীতের আগমনবার্তা।”
ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি কম, তবে ডিসেম্বরের শুরুতে সাগরে পরিবর্তন সম্ভব
ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কেও আশাব্যঞ্জক তথ্য দিয়েছে বিডব্লিউওটি। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০ নভেম্বরের আগে বঙ্গোপসাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
এই সময়টিতে সাগরে একটি বৃষ্টি বলয় (rain belt) গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তা সৃষ্টি হয়, তাহলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সামান্য বৃষ্টিপাত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বরের শুরুতে সামান্য বৃষ্টির পরপরই দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রথম শৈত্যপ্রবাহ নেমে আসবে।
শৈত্যপ্রবাহ কবে, কোথায়?
বিডব্লিউওটি’র মতে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে। এটি হবে মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ।
রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনা অঞ্চলে তাপমাত্রা ৮ থেকে ৯ ডিগ্রিতে নেমে আসতে পারে।
এরপর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শীত ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করবে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ মধ্যাঞ্চলে, এবং ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় স্পষ্ট শীত অনুভূত হবে।
এবারের শীত কেমন হতে পারে?
আবহাওয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫ সালের শীত আগের বছরের তুলনায় কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী ও শুষ্ক হতে পারে। কারণ, চলতি বছর এল-নিনো প্রভাব থাকায় মৌসুমি বৃষ্টি কিছুটা কম হয়েছে, যা সাধারণত শীতকে দীর্ঘায়িত করে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) এক কর্মকর্তার ভাষায়, “এবারের শীতে দুই থেকে তিনটি মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ দেখা যেতে পারে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের উত্তরাঞ্চল ছাড়াও মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও এবার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম থাকতে পারে।”
স্বাস্থ্য সতর্কতা: শীতের শুরুতেই সতর্ক থাকুন
শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি, হাঁপানি, চর্মরোগ ও জ্বরের মতো মৌসুমি রোগ বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের এই সময় অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শীতের শুরুতেই ঠান্ডা বাতাসে দীর্ঘ সময় না থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রাতে বা ভোরে বাইরে বের হলে উষ্ণ পোশাক ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলে আগুন জ্বালানোর সময় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, কারণ অতিরিক্ত ধোঁয়া শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে।
শীতকালীন উৎসব ও পর্যটনের প্রস্তুতি
শীত মানেই উৎসবের মৌসুম। পিঠা-পায়েস, নবান্ন, পিকনিক, বনভোজন, বিয়ের অনুষ্ঠান—সবকিছুতেই শীতের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সুন্দরবনে পর্যটকের ভিড় বাড়বে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “শীতের শুরু থেকেই পর্যটন এলাকায় হোটেল বুকিং বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম জমজমাট থাকবে।”
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আগামী ১০ নভেম্বর থেকে শীতের সূচনা হতে যাচ্ছে। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রথম শৈত্যপ্রবাহ নামবে, এবং জানুয়ারিতে পড়বে তীব্র ঠান্ডা।
চলতি নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আবহাওয়া কৃষিকাজের জন্য অনুকূল থাকবে, বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম, এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিও নেই।
অতএব, বলা যায়—বাংলাদেশে শুরু হচ্ছে শীতের পদচারণা। সামনে আসছে হিমেল হাওয়া, শিশিরভেজা সকাল আর পিঠা-পায়েসের আনন্দময় দিনগুলো।
MAH – 13642 I Signalbd.com



