রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানহা বিনতে বুশরার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় প্ররোচনার অভিযোগ উঠেছে তার প্রেমিক সায়মনের বিরুদ্ধে। পরিবার বলছে, সম্পর্কের টানাপোড়েনেই সম্ভাবনাময় এই তরুণীর জীবন শেষ হয়ে গেছে।
ঘটনার সারসংক্ষেপ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর শিক্ষার্থী তানহা বিনতে বুশরার (২৩) মরদেহ। সোমবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে ধারণা করা হলেও, পরিবারের দাবি—প্রেমিক সায়মনের মানসিক নির্যাতন ও সম্পর্কের টানাপোড়েনই এই মৃত্যুর মূল কারণ।
তানহার পরিবার ও সহপাঠীদের দাবি, ঘটনাটির সঠিক তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেষ কথোপকথনে বাবাকে তানহার কান্না
তানহার বাবা আবুল বাশার জানান, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মেয়ে ফোনে বলেছিল, “বাবা, আমার মন ভালো নেই, তুমি ঢাকায় আসো, আমাকে নিয়ে যাও।”
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পান তিনি।
বিমর্ষ কণ্ঠে তিনি বলেন, “উচ্চশিক্ষার জন্য মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। এখন আমাকে মেয়ের লাশ নিতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, ওই ছেলেটাই আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী।”
পরিবারের অভিযোগ, সায়মনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, অবহেলা ও মানসিক চাপের কারণেই তানহা চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তানহা ও সায়মনের সম্পর্কের শুরু ও টানাপোড়েন
তানহার সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তানহা ও সায়মন দুজনেই কুমিল্লার রেসকোর্স এলাকার বাসিন্দা। কলেজজীবন থেকেই তাদের পরিচয় ও সম্পর্কের শুরু।
সায়মন ঢাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য ইউল্যাবে ভর্তি হলে, তানহাকেও সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুরোধ করে।
প্রথমদিকে সম্পর্ক ভালো থাকলেও সম্প্রতি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সায়মন নাকি তানহার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
তানহার এক বান্ধবী জানান, “তানহা অনেক দিন ধরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। সে একাধিকবার বলেছিল যে সায়মন ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। এমনকি আত্মহত্যার কথাও বলেছিল, কিন্তু সায়মন বিষয়টা গুরুত্ব দেয়নি।”
পুলিশের বক্তব্য ও তদন্তের অগ্রগতি
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল ইসলাম জানান, সোমবার বিকেলে নবীনগর হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাট থেকে তানহার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে মৃত্যুর পেছনে প্ররোচনা বা অন্য কোনো বিষয় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তানহার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে, যা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে।
এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে অপমৃত্যুর মামলা হলেও, তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা হিসেবে তা পরিবর্তন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের শোক
তানহার মৃত্যুর পর ইউল্যাব ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করে বিচার দাবি করছেন।
এক সহপাঠী বলেন, “তানহা খুব মেধাবী ও প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। এমনভাবে তার মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
প্রতিবেশীরাও জানিয়েছেন, মেয়েটি সব সময় হাসিখুশি ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়।
তারা মনে করছেন, প্রেমিকের আচরণেই সে ভেঙে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইনি পদক্ষেপ ও পরিবারের দাবি
তানহার বাবা-মা সায়মনের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
আবুল বাশার বলেন, “আমার মেয়েকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে সে। তাকে বিচার না করলে অন্য মেয়েরাও এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা আইনজীবীর পরামর্শে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে, পুলিশও বলেছে—তদন্তে অভিযুক্তের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রশ্নে উদ্বেগ
তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কভিত্তিক মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে তানহার মৃত্যু।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙনের মতো মানসিক ধাক্কা তরুণদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এমন পরিস্থিতিতে পরিবার ও বন্ধুরা যেন দ্রুত পাশে দাঁড়ায় এবং পেশাদার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
একজন মনোবিদ বলেন, “মানসিক নির্যাতনও একটি সহিংসতা। অনেক সময় এটি শারীরিক সহিংসতার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।”
ইউল্যাবের মেধাবী ছাত্রী তানহা বিনতে বুশরার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, গোটা সমাজের জন্য এক বেদনাদায়ক বার্তা।
তার পরিবারের দাবি, প্রেমিক সায়মনকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা হোক।
এখন দেখার বিষয়, তদন্তে কী বেরিয়ে আসে এবং তরুণ সমাজ এমন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কতটা সচেতন হতে পারে।
এম আর এম – ২১০১,Signalbd.com



