বাংলাদেশ

দেখা হলো না সমুদ্র, পথেই শেষ ৫ তরতাজা প্রাণ

Advertisement

কক্সবাজারে আনন্দ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এক পরিবারের হাসি মুহূর্তেই পরিণত হলো বেদনায়। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চান্দিশকরা গ্রামের উদয় পাটোয়ারীর (৪৩) পরিবার একসঙ্গে যাচ্ছিল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটননগরী কক্সবাজারে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নের যাত্রা শেষ হয় ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায়—যেখানে প্রাণ হারান একই পরিবারের পাঁচজন।

আনন্দ ভ্রমণের পরিকল্পনা

উদয় পাটোয়ারী দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে কর্মরত। কর্মব্যস্ত জীবনের কারণে স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই পরিবার ও আত্মীয়দের নিয়ে কক্সবাজারে কয়েকদিনের জন্য ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করেন।
পরিবারের সবার মুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক—মা, স্ত্রী, সন্তান, বোন, শ্যালিকা—সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল একসঙ্গে ভ্রমণের। মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) রাতে তারা রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে রওনা দেন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।

দলটিতে ছিলেন উদয় পাটোয়ারী (৪৩), তার স্ত্রী ফারজানা মজুমদার লিজা (২৮), একমাত্র সন্তান সামাদ পাটোয়ারী (৪), শ্যালিকা ফারহানা মজুমদার টিজা (২৫), শ্যালক শাহেদ মজুমদার লিশান (২২)
পথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাজার থেকে মা রুমি বেগম (৬৫), বোন সাদিয়া আক্তার পাটোয়ারী (২৪) এবং ফালগুনকরা এলাকা থেকে শাশুড়ি রিজওয়ানা মজুমদার শিল্পী (৫৫) মাইক্রোবাসে ওঠেন। রাত আড়াইটার দিকে তারা সবাই একসঙ্গে কক্সবাজারের পথে যাত্রা অব্যাহত রাখেন।

মর্মান্তিক সংঘর্ষের মুহূর্ত

রাত পেরিয়ে ভোর। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ঢালা এলাকায় পৌঁছায় মাইক্রোবাসটি। সেই সময় বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগামী মারসা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস এসে ভয়াবহভাবে ধাক্কা দেয় মাইক্রোবাসটিকে।
দুর্ঘটনাটি এতটাই তীব্র ছিল যে ঘটনাস্থলেই মারা যান পাঁচজন।

নিহতরা হলেন:

  • ফারজানা মজুমদার লিজা (২৮) – উদয়ের স্ত্রী
  • রিজওয়ানা মজুমদার শিল্পী (৫৫) – শাশুড়ি
  • ফারহানা মজুমদার টিজা (২৫) – শ্যালিকা
  • রুমি বেগম (৬৫) – উদয়ের মা
  • সাদিয়া আক্তার পাটোয়ারী (২৪) – উদয়ের বোন

অন্যদিকে, মাইক্রোবাসের চালকসহ চারজন গুরুতর আহত হন। আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালচকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

পুলিশ ও স্থানীয়দের ভূমিকা

মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ মেহেদী হাসান বলেন, “ভোরের দিকে আমরা খবর পাই যে ফাঁসিয়াখালী ঢালার কাছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি মাইক্রোবাসটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, অনেক যাত্রী রক্তাক্ত অবস্থায় আটকে আছেন। স্থানীয়দের সহায়তায় আহতদের উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

স্থানীয় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মারসা পরিবহনের বাসটি অনেক গতিতে চলছিল। রাস্তা ছিল ভেজা ও পিচ্ছিল, সম্ভবত চালকের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। সংঘর্ষের শব্দ এত জোরে ছিল যে আশপাশের বাসিন্দারা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসেন।

পরিবারের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন

উদয় পাটোয়ারী বর্তমানে শোকে পাথর। নিজের চোখের সামনে প্রিয়জনদের হারানোর যন্ত্রণায় বাকরুদ্ধ তিনি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উদয়ের এক আত্মীয় বলেন, “উদয় ভাই সব সময় পরিবারের জন্য চিন্তা করতেন। ছেলেকে নিয়ে সমুদ্র দেখানোর স্বপ্ন ছিল তার। কে জানত, সেই যাত্রাই হবে শেষ যাত্রা।”

উদয়ের শ্বশুর আবদুল মন্নান মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে জানান,
“জামাতা উদয় কক্সবাজারে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছিল। রাতেই খবর পাই, ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এক পরিবারের পাঁচজন একসঙ্গে চলে যাবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না।”

নিহতদের বাড়িতে শোকের ছায়া

বুধবার সকাল থেকেই চৌদ্দগ্রামের চান্দিশকরা গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। একের পর এক লাশ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল পড়ে পুরো এলাকায়। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাই এসে ভিড় করেন উদয় পাটোয়ারীর বাড়িতে।
একজন প্রতিবেশী জানান, “এই পরিবারটা খুব ভদ্র আর সুখী পরিবার ছিল। সবাই মিলে আনন্দে থাকত। কিন্তু হঠাৎ এমন দুর্ঘটনায় পুরো গ্রামটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।”

চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিহত পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিহতদের দাফন ও আহতদের চিকিৎসায় সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক নিত্যদিনের দুঃসংবাদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে ৬,২৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি দুর্ঘটনার অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত। পর্যটন মৌসুমে এই সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ে দ্বিগুণেরও বেশি, কিন্তু তদারকি ও গতিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে খুবই দুর্বল।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা এবং রাস্তার খারাপ অবস্থা—এই চারটি প্রধান কারণেই প্রতিদিন এমন প্রাণহানি ঘটছে।
তাদের মতে, “যদি হাইওয়ে নিরাপত্তা জোরদার না করা হয়, তাহলে এমন দুর্ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব নয়।”

প্রশাসনের বক্তব্য

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, “আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসার সব খরচ স্থানীয় প্রশাসন বহন করবে।”
তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও মাইক্রোবাস উভয়ই জব্দ করা হয়েছে এবং তদন্ত শুরু হয়েছে।
“প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বাসের বেপরোয়া গতির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে,” বলেন তিনি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ক্ষোভ

দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকে লিখেছেন—“প্রতিদিন এত মৃত্যু, অথচ ব্যবস্থা কোথায়?”
চৌদ্দগ্রামের তরুণদের সংগঠন ‘আমরা চৌদ্দগ্রামবাসী’ ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে লিখেছে,
“একই পরিবারের পাঁচজনের প্রাণ গেছে—এটা শুধু এক পরিবারের ক্ষতি নয়, পুরো সমাজের ক্ষতি। এখনই সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার।”

পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও রাষ্ট্রীয় সহায়তার দাবি

স্থানীয় নাগরিক সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও প্রবাসী সংগঠনগুলো সরকারের কাছে নিহত পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা ও শিশুটির (সামাদ পাটোয়ারী) ভবিষ্যৎ শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
চৌদ্দগ্রাম প্রবাসী কল্যাণ সংগঠনের এক প্রতিনিধি বলেন, “উদয় ভাই আমাদের গর্ব ছিলেন। আমরা চাই সরকার ও সমাজ একত্রে এই পরিবারের পাশে দাঁড়াক।”

শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি

বুধবার বিকেলে নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালেই চান্দিশকরা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাদের জানাজা ও দাফনের প্রস্তুতি চলছে।
উদয় পাটোয়ারী হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তবুও জানাজায় উপস্থিত থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তিনি। পরিবারের একজন সদস্য বলেন, “উদয় ভাই শুধু বলছে, ‘আমি তো বেঁচে আছি কেন?’—এই কথাটাই সে বারবার বলছে।”

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়

বিশেষজ্ঞদের মতে,

  • মহাসড়কে স্পিড লিমিট মনিটরিং ব্যবস্থা কঠোরভাবে কার্যকর করা জরুরি।
  • রাতের যাত্রার জন্য বিশ্রামহীন চালকদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে।
  • প্রতিটি দুর্ঘটনায় বাস মালিক ও পরিবহন কোম্পানির দায় নির্ধারণ করতে হবে।
  • সচেতনতা বাড়াতে ড্রাইভার প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম নিয়মিত করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রোড সেফটি সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের অবহেলাই প্রধান কারণ। তাই মানুষ ও আইন—দুই দিক থেকেই কঠোরতা প্রয়োজন।”

একটি সুখী পরিবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরিণত হলো শোকে। কক্সবাজারে আনন্দ ভ্রমণের স্বপ্ন এখন কেবল কান্নার স্মৃতি।
এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের সড়ক এখনো নিরাপদ নয়। প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু সংখ্যার যোগফল নয়; এর পেছনে রয়েছে একেকটি ভাঙা পরিবার, ছিন্ন স্বপ্ন, নিভে যাওয়া ভবিষ্যৎ।

MAH – 13635 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button