আমেরিকার আকাশে আরেক ট্র্যাজেডি: উড্ডয়নের পরপরই ইউপিএস কার্গো বিমান বিধ্বস্ত
যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের লুইসভিল শহরের আকাশে ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউপিএস (UPS) নামের একটি কার্গো বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১১ জন।
দুর্ঘটনার পর পুরো এলাকা জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং স্থানীয় সময় অনুযায়ী বুধবার সকালে উদ্ধার তৎপরতা চলছিলো।
বিমানটি লুইসভিলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হাওয়াইয়ের হনোলুলুর উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। ইউপিএসের মালবাহী এই বিমানটিতে তিনজন ক্রু সদস্য ছিলেন। উদ্ধারকর্মীদের ধারণা, তারা সবাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
দুর্ঘটনার বিবরণ: আকাশে আগুনের গোলা হয়ে পড়ল বিমান
রয়টার্স ও বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, উড্ডয়নের মাত্র কয়েক মিনিট পরই বিমানটির ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকাল ৯টার দিকে আকাশে এক প্রবল শব্দ শোনা যায়, এরপরই দেখা যায় বিমানটি নিচে নামছে এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুনের বলয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা।
বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর চারদিকে ঘন কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। দমকল বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
কেনটাকির গভর্নর অ্যান্ডি বেসিয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, “এটি ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। আমরা উদ্ধারকাজে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, তবে কয়েকজনের অবস্থা সংকটজনক।”
ইউপিএসের প্রতিক্রিয়া: তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা
ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিস (UPS) একটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত লজিস্টিকস কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ঘটনার গভীর তদন্তে স্থানীয় প্রশাসন ও মার্কিন ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (FAA) সঙ্গে কাজ করছে।
এক মুখপাত্র বলেন,
“আমরা আমাদের তিনজন সহকর্মীর মৃত্যুর সংবাদে গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের অগ্রাধিকার এখন পরিবারগুলোর পাশে থাকা এবং তদন্তে সহযোগিতা করা।”
ইউপিএস জানায়, তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করেনি। কারণ, নিহতদের পরিবারের সম্মতি ছাড়া কোনো তথ্য প্রকাশ করা নৈতিক হবে না।
প্রাথমিক তদন্ত: ইঞ্জিন বিকল না কি আবহাওয়ার প্রভাব?
দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (NTSB) ও FAA।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি হয়তো ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ত্রুটি বা খারাপ আবহাওয়ার কারণে ঘটেছে। উড্ডয়নের সময় এলাকায় হালকা কুয়াশা ছিল, তবে তীব্র ঝড় বা বজ্রপাতের খবর পাওয়া যায়নি।
একজন স্থানীয় বিশ্লেষক জানান, “যদি বিমানটি উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পরই নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে সম্ভবত ইঞ্জিন ব্যর্থতা বা ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেমে সমস্যা হয়েছিল।”
তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, বিমানটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে। সেটি বিশ্লেষণ করলে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ স্পষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
লুইসভিল বিমানবন্দর সাময়িক বন্ধ: সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব
দুর্ঘটনার পরপরই লুইসভিল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এর ফলে ইউপিএসের মূল হাব হিসেবে ব্যবহৃত এই বিমানবন্দর দিয়ে চলা পণ্য পরিবহন কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
ইউপিএস ছাড়াও অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট, এবং মার্কিন ডাক বিভাগ (USPS)—এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে তাদের পণ্য সরবরাহ করে থাকে। ফলে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একজন ইউপিএস কর্মকর্তা বলেন, “লুইসভিল আমাদের প্রধান হাব। এখানকার অচলাবস্থা মানে হাজারো ডেলিভারি আটকে যাওয়া। তবে আমরা বিকল্প রুট ব্যবহার করে সেবায় বিঘ্ন না ঘটানোর চেষ্টা করছি।”
স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো
এই দুর্ঘটনাটি মার্কিন ইতিহাসের আরেকটি ভয়াবহ বিমান বিপর্যয়ের স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়েছে।
২০১৩ সালে আলাবামায় ইউপিএসের আরেকটি কার্গো বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, যেখানে দুই পাইলট নিহত হন।
তাছাড়া, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় কার্গো বিমান দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও কার্গো ফ্লাইটে যাত্রীবাহী বিমানের তুলনায় দুর্ঘটনা কম ঘটে, তবুও নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে যায় কারণ এই ফ্লাইটগুলো সাধারণত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্য বহন করে থাকে — যার মধ্যে বিপজ্জনক রাসায়নিকও থাকতে পারে।
স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা: ভয়াবহ শব্দে কেঁপে ওঠে শহর
লুইসভিলের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুর্ঘটনার সময় আকাশ থেকে বিকট শব্দ শোনা যায়, যেন বজ্রপাত হয়েছে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিমানটি নিচে নামার সময় আগুনের বলয়ে ঘিরে ছিল এবং মুহূর্তের মধ্যেই বিস্ফোরণের শব্দে আশপাশের বাড়িঘর কেঁপে ওঠে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী, মেরি অ্যান্ডারসন, বলেন,
“আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, আকাশে একটা আগুনের রেখা নিচের দিকে নেমে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। আমরা সবাই আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।”
স্থানীয় দমকলকর্মীরা জানান, আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে কিছুক্ষণের জন্য তারা ঘটনাস্থলে প্রবেশই করতে পারেননি। কয়েকটি কাছাকাছি বাড়িও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও শোকবার্তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়,
“এই দুর্ঘটনা আমাদের আবার মনে করিয়ে দিল—যানবাহনের নিরাপত্তা ও বিমান পরিবহনে প্রযুক্তিগত মান বজায় রাখা কতটা জরুরি।”
কংগ্রেস সদস্য ও স্থানীয় নেতারা দুর্ঘটনার দ্রুত তদন্ত দাবি করেছেন। অনেকেই বলেছেন, ইউপিএসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের বিমান রক্ষণাবেক্ষণে আরও স্বচ্ছতা ও নিয়মিত পরীক্ষা প্রয়োজন।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া: বিমান নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ
এই দুর্ঘটনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, পুরো বিশ্বের বিমান চলাচল নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি উন্নত হলেও পুরোনো মডেলের কার্গো বিমানগুলো এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ঝুঁকি বাড়ায়।
তারা দাবি করেছেন, পুরোনো বিমানের ইঞ্জিন ও কন্ট্রোল সিস্টেম আধুনিক প্রযুক্তিতে আপডেট করা না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে।
সমাপনী বিশ্লেষণ: নিরাপত্তার প্রশ্নে নতুন করে ভাবতে হবে
বিমান দুর্ঘটনা যেমন মানবিক ট্র্যাজেডি, তেমনি এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় আঘাত।
ইউপিএসের মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিমান দুর্ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তিগত উন্নতি থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রতিটি ফ্লাইটের আগে কঠোর পরিদর্শন, প্রশিক্ষিত ক্রু, এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করলেই কেবল এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব।
লুইসভিলের এই দুর্ঘটনা আমেরিকার বিমান চলাচল ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। নিহত তিনজনের পরিবারের শোক আজ গোটা বিমান শিল্পের জন্য সতর্কবার্তা—নিরাপত্তার প্রশ্নে কখনোই অবহেলা করা চলবে না।
MAH – 13625 I Signalbd.com



