নেপালের হিমালয়ের ইয়ালুংরি বেস ক্যাম্পের কাছে ভয়াবহ তুষার ধসের ঘটনায় সাত পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পাঁচজন বিদেশি এবং দুজন স্থানীয় নেপালি গাইড বা শেরপা। উদ্ধারকর্মীরা এখনো তুষারের নিচে চাপা পড়ে থাকা নিখোঁজদের মরদেহ উদ্ধারে তৎপর রয়েছেন।
দুর্ঘটনার বিস্তারিত: হিমালয়ের দোলাখায় তুষার ধসের সময়ের ভয়াবহতা
স্থানীয় সময় সোমবার (৩ নভেম্বর) বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে নেপালের দোলাখা জেলার ইয়ালুংরি বেস ক্যাম্পের কাছে এই তুষারধস ঘটে। পর্বত অভিযাত্রীদের দলটি তখন শৃঙ্গ আরোহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পর্বত অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা ‘সেভেন সামিট ট্রেকস’ জানিয়েছে, তুষারধস এতটাই হঠাৎ ঘটে যে, আরোহীরা আশ্রয় নেওয়ার সুযোগই পাননি।
তুষারের বিশাল ঢল মুহূর্তের মধ্যে ক্যাম্পে আঘাত হানে এবং কয়েকজন আরোহী সঙ্গে সঙ্গে তুষারের নিচে চাপা পড়েন। ঘটনায় আহত আরও আটজনকে উদ্ধার করে রাজধানী কাঠমান্ডুর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ বিদেশি নাগরিক
নিহত সাতজনের মধ্যে দুজন ইতালির, একজন করে কানাডা, জার্মানি ও ফ্রান্সের নাগরিক। তাদের সঙ্গে ছিলেন দুই নেপালি গাইড বা শেরপা, যারা দীর্ঘদিন ধরে হিমালয় অভিযানের সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।
পর্বতারোহী সংস্থা ‘সেভেন সামিট ট্রেকস’-এর চেয়ারম্যান মিংমা শেরপা বলেছেন, উদ্ধারকারীরা এখন পর্যন্ত দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিদের মরদেহ তুষারের ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীরে চাপা পড়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
উদ্ধার অভিযান ব্যাহত করছে প্রতিকূল আবহাওয়া
স্থানীয় পুলিশ ও উদ্ধার দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, ভয়াবহ ঠান্ডা, তীব্র বাতাস ও ঘন তুষারপাতের কারণে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে। দুর্ঘটনাস্থলে হেলিকপ্টারে নামা সম্ভব হচ্ছে না; ফলে উদ্ধারকারীদের হাঁটাপথে সেখানে পৌঁছাতে হচ্ছে, যা সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
দোলাখা জেলার প্রশাসক বলেছেন, “আমরা প্রতিটি মুহূর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আবহাওয়া উন্নত হলে অতিরিক্ত উদ্ধারকারী দল পাঠানো হবে।” তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত উদ্ধারকাজে নেপালের সেনাবাহিনী, স্থানীয় গাইড ও আন্তর্জাতিক রেসকিউ দল একসঙ্গে কাজ করছে।
সাক্ষাৎকারে বেঁচে ফেরা এক আরোহীর অভিজ্ঞতা
দ্য কাঠমান্ডু পোস্টে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উদ্ধার হওয়া এক আরোহী বলেন, “তুষার ধসের শব্দ আমরা প্রথমে বজ্রপাত ভেবেছিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু সাদা তুষারে ঢেকে গেল। আমি আমার তিন সঙ্গীকে চোখের সামনে হারিয়ে ফেলেছি।”
তিনি আরও বলেন, “যদি উদ্ধারকাজ দ্রুত শুরু করা যেত, তাহলে হয়তো আরও কয়েকজনকে বাঁচানো যেত। দুর্ঘটনার পর আমরা বারবার সাহায্যের আবেদন করেছিলাম, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি।”
অভিযানের গন্তব্য ছিল দোলমা খাং শৃঙ্গ
নেপালি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অভিযাত্রী দলের মূল লক্ষ্য ছিল হিমালয়ের দোলমা খাং শৃঙ্গে আরোহণ করা, যার উচ্চতা প্রায় ৬ হাজার ৩৩২ মিটার। তবে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তারা আগে ইয়ালুংরি শৃঙ্গে (উচ্চতা ৫ হাজার ৬৩০ মিটার) আরোহণের পরিকল্পনা করেছিল।
তুষারধসটি ঠিক সেই প্রস্তুতিমূলক অভিযানের সময় ঘটে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওই এলাকায় সাম্প্রতিক ভারী তুষারপাত ও তীব্র বাতাসের কারণে তুষারের স্তর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, যা ধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তুষারধসের কারণ ও বিশেষজ্ঞ মত
পর্বত ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপালের হিমালয় অঞ্চলে তুষারধসের ঘটনা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফস্তরের স্থিতিশীলতা কমে যাচ্ছে, ফলে সামান্য কম্পন বা তাপমাত্রা পরিবর্তনেই ভয়াবহ ধসের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
নেপালের পর্বতারোহণ বোর্ডের কর্মকর্তা ধ্রুব লামা বলেন, “প্রতিটি অভিযানে আবহাওয়া ও তুষারস্তরের অবস্থা আগে যাচাই করা জরুরি। কিন্তু অনেক সময় বাণিজ্যিক অভিযানের তাড়ায় এসব প্রাথমিক নিরাপত্তা পদক্ষেপ উপেক্ষা করা হয়, যার ফলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধার সহায়তা
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর নিহতদের নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপাল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইতালি, জার্মানি ও কানাডা ইতিমধ্যে উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা প্রস্তাব করেছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের প্রতিনিধিরাও ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছেন।
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের নাগরিকদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নেপাল সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে উদ্ধার ও দেহ repatriation কার্যক্রমে কাজ করছি।”
হিমালয়ের দুর্গম শৃঙ্গে এমন তুষারধস আবারও মনে করিয়ে দিল, প্রকৃতির সামনে মানুষ কতটা অসহায়। অভিযাত্রীদের সাহসিকতা প্রশংসনীয় হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নেপাল সরকার ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে পাহাড়ি অঞ্চলের অনিশ্চিত আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন ঝুঁকি ভবিষ্যতেও থাকবেই বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এম আর এম – ২০৮৭,Signalbd.com



