সারাদেশের তিন শতাধিক বিচারককে জেলা জজ পদে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভা। মঙ্গলবার বিকেলে অনুষ্ঠিত এ সভায় দেশের অধস্তন আদালত ব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি দুই শতাধিক বিচারককে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে উন্নীত করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ভবনে ফুলকোর্ট সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় মোট ২০টিরও বেশি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, প্রশাসনিক কাঠামোর উন্নয়ন, এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনা। দীর্ঘ আলোচনার পর সর্বসম্মতভাবে তিন শতাধিক বিচারককে জেলা জজ পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
একই সঙ্গে অতিরিক্ত দুই শতাধিক বিচারককে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে উন্নীত করার বিষয়েও অনুমোদন দেওয়া হয়।
রেইনট্রি মামলার বিতর্ক ও কামরুন্নাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত
সভায় আলোচিত অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল আলোচিত ‘রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলা’। ওই মামলায় আপিল বিভাগের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও একজন আসামিকে জামিন দেওয়ায় বিচারিক ক্ষমতা হারানো জেলা জজ কামরুন্নাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রসঙ্গও উঠে আসে।
এ বিষয়ে সভায় আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়—বিচারপতি কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা পুনর্বহাল করা হবে কি না, তা পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে জিএ (জাজেস অ্যাফেয়ার্স) কমিটিকে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেবে।
একজন সিনিয়র বিচারপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় বিষয়টি সংবেদনশীল। তাই জিএ কমিটি স্বাধীনভাবে যাচাই-বাছাই করবে।”
পদোন্নতি প্রাপ্ত বিচারকদের তালিকা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, জেলা জজ পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিচারকরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জেলায় সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ফুলকোর্ট সভার অনুমোদনের পর এখন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে পদোন্নতির সুপারিশপত্র। এরপর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে আনুষ্ঠানিক গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে পদোন্নতি কার্যকর হবে।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে, চলতি মাসের মধ্যেই পদোন্নতিপ্রাপ্তদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ফুলকোর্ট সভায় আলোচিত অন্যান্য বিষয়
সভায় কেবল পদোন্নতি নয়, বিচার বিভাগের উন্নয়ন, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসার এবং মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়ানোর উপায় নিয়েও আলোচনা হয়।
বিচারপতিরা মত দেন যে, জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ের বিচারকদের প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ বাড়ানো প্রয়োজন। মামলার জট নিরসনে অনলাইন কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আরও আধুনিকীকরণের প্রস্তাবও আসে সভায়।
এছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক ক্যালেন্ডার অনুমোদনের বিষয়টিও আলোচ্যসূচিতে থাকলেও সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে তা পরবর্তী সভায় নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
বিচারক পদোন্নতির প্রক্রিয়া ও গুরুত্ব
বিচার বিভাগে জেলা জজ পদোন্নতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। অধস্তন আদালতের বিচারকরা সিনিয়রিটি, যোগ্যতা, নৈতিক মানদণ্ড এবং কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে এই পদে উন্নীত হন।
প্রতিবছর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় এই পদোন্নতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পদোন্নতি শুধু ব্যক্তিগত মর্যাদা বৃদ্ধি করে না, বরং বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০২৪ সালেও প্রায় ২৮০ জন বিচারক জেলা জজ পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এবারের সংখ্যা তিন শতাধিক হওয়ায় এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিচার বিভাগের সক্ষমতা আরও বাড়বে
বিচার বিশ্লেষক ও আইনজীবীরা মনে করছেন, এই পদোন্নতির মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচার কার্যক্রমে গতি আসবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের এক সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “দেশজুড়ে মামলা নিষ্পত্তিতে জেলা জজদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন পদোন্নতি পেলে জেলা আদালতগুলোতে নেতৃত্ব আরও সুসংহত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা বিচারকদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে, যা আদালতের সামগ্রিক কর্মদক্ষতা বাড়াবে।”
সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভার এই পদোন্নতি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় নতুন গতি সঞ্চার করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তিন শতাধিক বিচারক জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব নিলে আদালতের বিচার কার্যক্রম আরও দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে দুই শতাধিক অতিরিক্ত জেলা জজ নিয়োগে মামলার জট কমবে এবং সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ আরও সহজ হবে।
তবে অনেকেই মনে করছেন, পদোন্নতির পাশাপাশি বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি—তাহলেই এই উদ্যোগ পূর্ণ সফলতা পাবে।
এম আর এম – ২০৮৩,Signalbd.com



