সুদানের উত্তর করদোফানে সম্প্রতি ড্রোন হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। এই হামলা চালিয়েছে দেশটির প্রভাবশালী আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। নিহতদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো একটি কৌশলগত হামলা হিসেবে দেখছেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তীব্র নিন্দার বিষয় হতে পারে।
তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে সোমবার এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-ওবেইদের পূর্বাঞ্চলীয় আল-লুয়াইব গ্রামে এই হামলা চালানো হয়। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, হামলার লক্ষ্য ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত তাঁবু, যেখানে তখন অনেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
হামলার প্রেক্ষাপট
সুদান বর্তমানে একটি অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরএসএফ, যা মূলত পূর্বতন জেনারেল মুহাম্মদ হামদান দগ্লার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আধাসামরিক বাহিনী, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আধাসামরিক এই বাহিনী স্থানীয় জনগণের উপর চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার এবং ভয় সৃষ্টি করতে ড্রোন হামলার মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
স্থানীয় এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, “এই হামলায় নারী ও শিশুদেরও প্রাণহানি হয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক, কারণ নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে উদ্দেশ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। আমরা এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করছি।”
আরএসএফের আগের কর্মকাণ্ড
এই হামলা নতুন কিছু নয়। গত ২৬ অক্টোবর আরএসএফ উত্তর দারফুর প্রদেশের রাজধানী এল-ফাশের শহর দখল করে। দখলের পর সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সেই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি সতর্কবার্তা দেয়।
এছাড়া, সম্প্রতি আরএসএফ ঘোষণা করেছিল, তারা শিগগিরই আল-ওবেইদ শহরে হামলা চালাবে। এই ঘোষণা স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
প্রাদেশিক সরকারের বক্তব্য
উত্তর করদোফানের প্রাদেশিক সরকার বেসামরিক মানুষের ওপর আরএসএফের এই হামলাকে ‘নিরপরাধ মানুষ হত্যার’ নতুন প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে, আরএসএফকে অবিলম্বে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করতে।
প্রাদেশিক কর্মকর্তারা বলেন, “নারী, শিশু এবং বৃদ্ধসহ বহু মানুষ আমাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন। আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। আরএসএফের এই কর্মকাণ্ড মানবতার বিপক্ষে একটি গুরুতর অপরাধ।”
সুদানের ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি
সুদানের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতা দেশটিতে মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে, হাজার হাজার লোক খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হাহাকার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরএসএফের ড্রোন হামলা এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
মহামানবিক সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই সুদানে জরুরি সহায়তা প্রদান করছে, তবে নিরাপত্তার অভাবে অনেক অঞ্চলে এই সাহায্য পৌঁছানো কঠিন। বিশেষ করে উত্তর করদোফান এবং দারফুর প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শিশু ও নারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই হামলার খবর প্রকাশ করেছে, বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশগুলো এখন পর্যন্ত কোন শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, আরএসএফের মতো আধাসামরিক বাহিনী যদি এমন হামলা চালাতে থাকে, তাহলে সুদানের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে হাজার হাজার লোক সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে যেতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যেই চাদ, ইথিওপিয়া এবং মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে সুদানের নাগরিকদের অভিবাসনের চাপ লক্ষ্য করা গেছে।
প্রযুক্তি ও আধুনিক যুদ্ধ কৌশল
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরএসএফের ড্রোন হামলা আধুনিক যুদ্ধের নতুন দিকের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পূর্বে সাধারণত স্থলবাহিনী ব্যবহার করে হামলা চালানো হতো, কিন্তু এখন আধাসামরিক বাহিনী ড্রোন এবং দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তি নিরস্ত্র জনগণের ওপর হামলা চালানোকে আরও সহজ করে তুলেছে।
ড্রোন হামলা শুধুমাত্র মানুষ হত্যা নয়, বরং সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করতেও কার্যকর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে যদি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন এবং নজরদারি ব্যবস্থা শক্ত না করা হয়, তবে এমন হামলার ঘটনা আরও বাড়বে।
প্রাদেশিক নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া
হামলার পর স্থানীয় জনগণ হতাশ ও ভীত। অনেকেই জানিয়েছেন, তারা রাতভর তাঁদের পরিবার ও শিশুদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছেন। স্থানীয় সমাজকর্মীরা জানিয়েছেন, বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তায় সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা কার্যকরভাবে এগিয়ে না আসায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে।
এক স্থানীয় শিক্ষক বলেন, “আমরা শুধু শান্তিতে জীবন যাপন করতে চাই। কিন্তু প্রতিদিন ড্রোন হামলার ভয় আমাদের ঘরে প্রবেশ করেছে। বাচ্চারা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে, বাজারে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।”
সুদানের ভবিষ্যৎ
সুদানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আরএসএফের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় পদক্ষেপ না থাকলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এবং শান্তি রক্ষা বাহিনী দ্রুত সুদানে পাঠানো প্রয়োজন।
উত্তর করদোফান ও দারফুর প্রদেশের মানুষদের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরএসএফের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি না হলে সুদানের সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হামলা ও অস্থিরতার শিকার হতে থাকবে।
সুদানের উত্তর করদোফানে আরএসএফের ড্রোন হামলায় নিহত ৪০ জনের ঘটনা শুধু স্থানীয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শান্তির জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের প্রাণহানির মাধ্যমে প্রকাশিত এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এবং কার্যক্রমের ঘাটতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সুদানের মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আরএসএফকে আন্তর্জাতিকভাবে দায়িত্বে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
MAH – 13609 I Signalbd.com



