মামদানিকে ভোট না দেয়ার আহ্বান ট্রাম্পের
নিউ ইয়র্ক সিটির আসন্ন মেয়র নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন নিউজ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে বামপন্থি প্রার্থী জোহরান মামদানিকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছেন, “যদি মামদানি জয়ী হন, তাহলে ফেডারেল সরকারের অর্থ নিউ ইয়র্কে পৌঁছাতে দেওয়া হবে না।” তার এই মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
জোহরান মামদানি কে?
জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের অ্যাস্টোরিয়া এলাকার প্রতিনিধি এবং একজন প্রগতিশীল বামপন্থি রাজনীতিক। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ছোটবেলায় তার পরিবার কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন।
মামদানি ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা (DSA) দলের সক্রিয় সদস্য এবং নিউ ইয়র্ক রাজ্যের রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তার রাজনীতি মূলত সামাজিক ন্যায়বিচার, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসীদের অধিকার ও জলবায়ু ন্যায়বিচার কেন্দ্রিক।
তবে রক্ষণশীল রাজনীতিকদের চোখে তিনি “চরম বামপন্থি”। এই কারণেই ট্রাম্পের মতো রক্ষণশীল নেতাদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান
সোমবার (৩ নভেম্বর) নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন,
“আপনি ব্যক্তিগতভাবে অ্যান্ড্রু কুওমোকে পছন্দ করুন বা না করুন, আপনার কোনো বিকল্প নেই। আপনাকে অবশ্যই তাকে ভোট দিতে হবে, এবং আমি আশা করি তিনি দারুণ কাজ করবেন।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সরাসরি অ্যান্ড্রু কুওমো–র প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। ট্রাম্প নিজে রিপাবলিকান হলেও, এই নির্বাচনে তিনি এক ডেমোক্র্যাট বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন—যা মার্কিন রাজনীতিতে বিরল ঘটনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প আসলে “বামপন্থি শক্তির উত্থান” ঠেকাতে কুওমোকে একটি “কৌশলগত পছন্দ” হিসেবে দেখছেন।
অ্যান্ড্রু কুওমো: বিতর্কিত কিন্তু প্রভাবশালী রাজনীতিক
অ্যান্ড্রু কুওমো নিউ ইয়র্ক রাজ্যের সাবেক গভর্নর। তিনি ২০২১ সালে যৌন হয়রানির অভিযোগের মুখে পদত্যাগ করেন, কিন্তু রাজনীতির মঞ্চ থেকে সম্পূর্ণ সরে যাননি। বর্তমানে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচনে লড়ছেন এবং নিজেকে “অভিজ্ঞ প্রশাসক ও ভারসাম্যের প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরছেন।
ট্রাম্পের এই সমর্থন কুওমোর জন্য একদিকে যেমন রাজনৈতিক সুবিধা আনতে পারে, তেমনি অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট শিবিরে বিতর্কও সৃষ্টি করতে পারে।
নিউ ইয়র্কের রাজনীতিতে নতুন মোড়
নিউ ইয়র্ক ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি। কিন্তু গত কয়েক বছরে শহরের অপরাধ প্রবণতা, অভিবাসন সমস্যা এবং কর নীতিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
এ অবস্থায় মামদানি “জনগণের পক্ষে” এবং কুওমো “অভিজ্ঞ প্রশাসক” হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের এই হস্তক্ষেপ নির্বাচনের ভারসাম্য বদলে দিতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাইকেল হ্যানসন বলেন,
“ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ মূলত জাতীয় রাজনীতির অংশ। তিনি চান বাম ঘরানার প্রভাব নিউ ইয়র্কে কমে যাক, যাতে ভবিষ্যৎ জাতীয় নির্বাচনে রিপাবলিকানরা ভালো ফল করতে পারে।”
অন্যদিকে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড. সারা লোপেজ মনে করেন,
“ট্রাম্পের বক্তব্য ভোটারদের একাংশকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে নিউ ইয়র্কের উদারপন্থি ভোটাররা সাধারণত এসব হুমকিতে ভীত হন না।”
মামদানির প্রতিক্রিয়া
জোহরান মামদানি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন,
“যদি আমার নীতিই ট্রাম্পের কাছে এত ভয়ের কারণ হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমি সঠিক পথে আছি। নিউ ইয়র্ক সবার জন্য, কেবল ধনীদের জন্য নয়।”
তার এই বক্তব্য দ্রুত ভাইরাল হয়েছে এবং তরুণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
নিউ ইয়র্কবাসীর প্রতিক্রিয়া
নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণ মানুষ মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ বলছেন, ট্রাম্পের হুমকি “গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী”, আবার কেউ বলছেন “মামদানির নীতিগুলো অতিরিক্ত বামঘেঁষা”।
নিউ ইয়র্কের ট্যাক্সিচালক মো. আজিজ বলেন,
“মামদানি অভিবাসীদের জন্য কাজ করেছেন। তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা বলেন। ট্রাম্পের কথায় কেউ ভোট বদলাবে না।”
অন্যদিকে, ব্রঙ্কস এলাকার এক বাসিন্দা এলিজাবেথ মেয়ার বলেন,
“আমি কুওমোকে বেশি বিশ্বাস করি। তিনি রাজনীতি বোঝেন, ট্রাম্প যা বলেছেন তা পুরোপুরি মিথ্যা নয়।”
মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাব
এই নির্বাচন শুধুমাত্র নিউ ইয়র্কের জন্য নয়, বরং পুরো মার্কিন রাজনীতির জন্য একটি বড় বার্তা বহন করছে। আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই ট্রাম্প এখন থেকেই নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে চাইছেন।
যদি মামদানি জয়ী হন, তবে তা হবে বামপন্থি আন্দোলনের জন্য এক বিশাল বিজয়। আর ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানদের জন্য এটি এক প্রকার “রাজনৈতিক বিপর্যয়” হিসেবে দেখা হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে,
“ট্রাম্পের মন্তব্য কেবল স্থানীয় রাজনীতিকে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটি প্রমাণ করে, মার্কিন রাজনীতির বিভাজন কতটা গভীরে পৌঁছেছে।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়া এই ঘটনাকে “ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশলের নতুন অধ্যায়” বলে অভিহিত করেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচন নিউ ইয়র্কের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। মামদানি যদি জয়ী হন, তবে তা হবে অভিবাসী ও শ্রমজীবী শ্রেণির রাজনীতির নতুন জাগরণ। আর কুওমো জিতলে, তা হবে “অভিজ্ঞ প্রশাসনের প্রত্যাবর্তন।”
ট্রাম্পের বক্তব্যে আপাতত রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলেও, বাস্তবে এই ঘটনাই ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচন ২০২৫ এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আলোচিত ইস্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য আহ্বান, জোহরান মামদানির বামপন্থি ভাবনা এবং অ্যান্ড্রু কুওমোর প্রত্যাবর্তন—সব মিলিয়ে এই নির্বাচন যেন এক রাজনৈতিক নাটক।
MAH – 13607 I Signalbd.com



