বাংলাদেশ

ডেঙ্গু কেড়ে নিল আরও ৩ প্রাণ, একদিনে হাসপাতালে ভর্তি ৯২৮ জন

Advertisement

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আবারও বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও তিনজন, আর একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নতুন ৯২৮ জন রোগী। চলতি বছরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৮-এ।

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৯২৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৭৮ জনের মৃত্যু হলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতের শুরুতে আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং পানি জমে থাকা জায়গাগুলিতে মশার প্রজনন বৃদ্ধিই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

ডেঙ্গুতে নতুন মৃত্যু ও আক্রান্তের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৯২৮ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই ভর্তি হয়েছেন সর্বাধিক রোগী।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৪২ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে বরিশালে ১২০ জন, চট্টগ্রামে ৮৮ জন, রাজশাহীতে ৬৩ জন, ময়মনসিংহে ৫৬ জন, খুলনায় ৪৬ জন, রংপুরে ১৩ জন ও সিলেট বিভাগে ৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দুইজন ও ময়মনসিংহ বিভাগে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

চলতি বছরের সামগ্রিক চিত্র

২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৬৯ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৬ হাজারেরও বেশি রোগী ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা ২৭৮ ছাড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হলেও আশঙ্কাজনক।

গত বছর ২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক লাখ এক হাজারেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, এবং মৃত্যুবরণ করেন ৫৭৫ জন। আর ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও ভয়াবহ—তখন ডেঙ্গুতে মারা যান এক হাজার ৭০৫ জন মানুষ।

রাজধানী ও বিভাগভিত্তিক পরিস্থিতি

ঢাকা শহর এখনও ডেঙ্গুর মূল কেন্দ্র হিসেবে রয়েছে। এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে রাজধানীর অনেক জায়গায় এখনো পানি জমে আছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মৃত্যু ও আক্রান্ত—দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা সর্বাধিক।

চলতি বছর এ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণে ১৩৪ জন, উত্তর সিটিতে ৪১ জন, বরিশালে ৪০ জন, চট্টগ্রামে ২৫ জন, রাজশাহীতে ১৪ জন, ময়মনসিংহে ১২ জন, খুলনায় ৮ জন, ঢাকার বাইরের জেলায় ৩ জন এবং সিলেটে ১ জন মারা গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।

আবহাওয়াজনিত প্রভাব ও সতর্কতার অভাব

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌসুমি পরিবর্তনের সময় মশার প্রজনন বেড়ে যায়। অক্টোবরে হালকা বৃষ্টি এবং উষ্ণ–আর্দ্র আবহাওয়া ডেঙ্গুর বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের জনস্বাস্থ্য বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “এই সময় ঘরের কোণ, ছাদ, ড্রেন, ফুলের টব, এমনকি ফ্রিজের পানিও মশার জন্মস্থল হয়ে ওঠে। নাগরিকরা যদি নিয়মিত পরিষ্কার না রাখেন, তাহলে সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা ও নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান। শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, ঘরোয়া পর্যায়েও সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।”

সরকারি উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ

ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনগুলো নিয়মিত ফগিং, লার্ভা ধ্বংস কার্যক্রম ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে সেসব উদ্যোগের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা নিয়মিতভাবে মশা নিধন কার্যক্রম চালাচ্ছি। কিন্তু অনেক বাসাবাড়ির ছাদ বা বন্ধ জায়গায় জমে থাকা পানি এখনো মশার প্রজননের সুযোগ দিচ্ছে। নাগরিক সহযোগিতা ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”

ভবিষ্যৎ আশঙ্কা ও প্রতিরোধ পরামর্শ

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, নভেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে। তাই এখনই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ জোরদার করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—

  • বাড়ির চারপাশে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে।
  • ফুলের টব, ড্রাম বা ফ্রিজের পানির নিচে জমে থাকা পানি প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
  • সকালে ও সন্ধ্যায় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
  • শিশু ও বয়স্কদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, বরং এটি সারা বছরজুড়ে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে হলে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই হতে পারে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সময়মতো সচেতনতা ও সতর্কতা নিলেই হয়তো এই প্রাণঘাতী রোগের ভয়াবহতা কিছুটা কমানো সম্ভব।

এম আর এম – ২০১৪,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button