বাংলাদেশে আজ (৩০ অক্টোবর ২০২৫) থেকে কার্যকর হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আজকের পর যেকোনো জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) ১০টির বেশি সক্রিয় সিম থাকলে অতিরিক্ত সিমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রায় কয়েক লাখ মোবাইল ব্যবহারকারীর সিম আজ রাতের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি মূলত অবৈধ সিম ব্যবহার, প্রতারণা, সাইবার অপরাধ ও অপরিচিত সিমের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ রোধের একটি উদ্যোগ।
কেন নেওয়া হলো এই পদক্ষেপ
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সক্রিয় মোবাইল সিমের সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি ৬২ লাখ। অথচ বাংলাদেশে প্রকৃত মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৭৫ লাখ। অর্থাৎ একজন ব্যবহারকারীর নামে গড়ে তিনটিরও বেশি সিম রয়েছে।
এর মধ্যে ৮০ শতাংশ গ্রাহকের নামে পাঁচটির কম সিম রয়েছে। প্রায় ১৬ শতাংশ গ্রাহকের নামে ৬ থেকে ১০টি সিম, আর ১১টির বেশি সিম রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ ব্যবহারকারীর নামে। এই অতিরিক্ত সিমগুলোই অনেক ক্ষেত্রে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছে বিটিআরসি।
একজন কমিশন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “অনেকেই একাধিক অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অফার বা নেটওয়ার্ক কভারেজের কারণে। কিন্তু কিছু সিম অবৈধভাবে অন্যদের হাতে চলে যায়। এগুলো থেকেই প্রতারণা, হ্যাকিং, কিংবা চাঁদাবাজির মতো অপরাধ ঘটে।”
কীভাবে জানবেন আপনার নামে কতটি সিম আছে
বিটিআরসি জানিয়েছে, যেকোনো নাগরিক চাইলে খুব সহজেই জানতে পারেন তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) কতটি সিম নিবন্ধিত আছে। এজন্য মোবাইল ফোন থেকে *16001# ডায়াল করে এনআইডির শেষ চারটি সংখ্যা লিখে পাঠাতে হবে। এরপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আপনার নিবন্ধিত সিমগুলোর তথ্য এসএমএসে চলে আসবে।
যদি দেখা যায় ১০টির বেশি সিম রয়েছে, তাহলে প্রয়োজনীয় সিমগুলো রেখে বাকিগুলো বাতিল করতে হবে।
অতিরিক্ত সিম বন্ধ করার নিয়ম
যাদের নামে ১০টির বেশি সিম রয়েছে, তারা তাদের পছন্দমতো ১০টি সিম রেখে বাকি সিমগুলো ডি-রেজিস্টার করতে পারবেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।
অপারেটররা হলো:
- গ্রামীণফোন
- রবি আজিয়াটা
- বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস
- টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড
সময়সীমা শেষে বিটিআরসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত সিমগুলো বাতিল করে দেবে। ব্যবহারকারী যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজে ব্যবস্থা না নেন, তবে দৈবচয়ন (random selection) পদ্ধতিতে কিছু সিম বাতিল করা হবে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ নম্বর হারানোর আশঙ্কাও রয়েছে।
সচেতন না হলে ক্ষতি হতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ব্যবসায়ী, অনলাইন উদ্যোক্তা বা ডিজিটাল সেবা প্রদানকারীরা একাধিক সিম ব্যবহার করে থাকেন—কাস্টমার সার্ভিস, বিকাশ-নগদ-রকেটের আলাদা নম্বর কিংবা বিজ্ঞাপনের জন্য। তারা যদি সময়মতো সিমগুলো যাচাই না করেন, তবে ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ নম্বর বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক মো. রায়হান কবির বলেন,
“এই উদ্যোগের লক্ষ্য ভালো—কিন্তু অনেক ব্যবহারকারী সময়মতো জানেন না। বিশেষ করে যারা প্রবাসে আছেন বা দীর্ঘদিন সিম ব্যবহার করেননি, তাদের নামেও সিম থাকতে পারে যা আজ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সবাইকে এখনই এনআইডি যাচাই করতে হবে।”
বিটিআরসির যুক্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিটিআরসি জানিয়েছে, দেশে প্রতারণা ও সাইবার অপরাধ রোধে সিম নিবন্ধন ব্যবস্থা স্বচ্ছ করা এখন সময়ের দাবি। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন,
“আমরা চাই না কোনো নাগরিক তার নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ অপরাধ করুক। এজন্যই সিম ব্যবস্থাকে পরিষ্কার রাখা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এক এনআইডিতে সর্বোচ্চ ৫টি সিম রাখার দিকেও আমরা যেতে পারি।”
বিটিআরসি আরও জানিয়েছে, নতুন প্রজন্মের ই-সিম (eSIM) বা ভার্চুয়াল সিম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ই-সিমসহ সর্বমোট ১০টির বেশি সিম রাখা যাবে না।
মোবাইল অপারেটরদের প্রতিক্রিয়া
দেশের প্রধান চারটি মোবাইল অপারেটরই বিটিআরসির এই নির্দেশনা মেনে চলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
গ্রামীণফোনের এক মুখপাত্র জানান,
“আমরা ইতিমধ্যে গ্রাহকদের এসএমএস, সোশ্যাল মিডিয়া ও কাস্টমার কেয়ারের মাধ্যমে বারবার জানিয়ে দিয়েছি। অনেকেই ইতিমধ্যে অপ্রয়োজনীয় সিম ডি-রেজিস্টার করেছেন।”
রবি আজিয়াটার এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা চাই গ্রাহকরা যেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ নম্বর না হারান। এজন্য আমরা কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করেছি।”
বাংলালিংক জানিয়েছে, তাদের গ্রাহকদের প্রায় ৯৮ শতাংশের নামেই ১০টির কম সিম আছে। টেলিটক বলছে, সরকারি এই নির্দেশনা অনুসারে তারা ‘অটো-ব্লকিং’ সিস্টেম চালু করেছে।
অবৈধ সিম ও অপরাধের সংযোগ
গত কয়েক বছরে দেশের সাইবার অপরাধের বড় একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ‘অবৈধ সিম’। বিভিন্ন প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে, যেমন—ফেসবুক বা বিকাশ অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, পরিচয় চুরি, প্রেমের ফাঁদে প্রতারণা, কিংবা মিথ্যা চাকরির প্রলোভন—এসবের পেছনে প্রায়ই ব্যবহৃত হয় ভুয়া বা অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম।
২০২৩ সালে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দেশে চলমান অনলাইন প্রতারণার ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সিমগুলো ভুয়া বা অন্যের নামে নিবন্ধিত।
বিটিআরসির মতে, “যদি প্রতিটি সিম তার প্রকৃত মালিকের নামে নিবন্ধিত থাকে, তবে প্রতারণার সুযোগ অনেক কমে যাবে।”
প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা
অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির নামে দেশে সিম নিবন্ধিত রয়েছে, যা তারা অনেকদিন ব্যবহার করেননি। এ বিষয়ে বিটিআরসি জানিয়েছে, বিদেশে অবস্থানরত ব্যবহারকারীদের জন্য অনলাইন বা দূতাবাসের মাধ্যমে সিম যাচাই ও বাতিলের সুযোগ রাখা হবে।
বিদেশে থাকলেও নিজের এনআইডিতে নিবন্ধিত সিম যাচাই করতে পারবেন *16001# পদ্ধতিতে, যদি তার বাংলাদেশি নম্বর সক্রিয় থাকে।
গ্রাহকদের করণীয়: ধাপে ধাপে নির্দেশনা
১. আপনার মোবাইল থেকে *16001# ডায়াল করুন।
২. এনআইডির শেষ চারটি সংখ্যা লিখে পাঠান।
৩. এসএমএসে আপনি জানতে পারবেন আপনার নামে কতটি সিম রয়েছে।
৪. যদি ১০টির বেশি সিম দেখা যায়, তবে প্রয়োজনীয় ১০টি রেখে বাকিগুলো অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে ডি-রেজিস্টার করুন।
৫. প্রয়োজনে মালিকানা হস্তান্তরের আবেদন করতে পারেন।
৬. সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে সব কিছু সম্পন্ন করুন—নইলে গুরুত্বপূর্ণ সিম হারাতে পারেন।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী হাসান মাহমুদ বলেন,
“আমার নামে ১২টা সিম ছিল, যার মধ্যে কয়েকটা দোকানের কর্মচারীরা ব্যবহার করত। এখন আমি ১০টা রেখে বাকিগুলো বাতিল করেছি। নিয়মটা ভালো, কিন্তু আগে জানলে আরও সহজ হতো।”
চট্টগ্রামের গৃহিণী শবনম আক্তার বলেন,
“আমার বিকাশের একটা পুরনো নম্বর আছে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে অনেক ক্ষতি হবে। তাই আজকেই যাচাই করেছি।”
ভবিষ্যতে আরও কঠোর নিয়ম আসছে
বিটিআরসি জানিয়েছে, ভবিষ্যতে প্রতিটি সিমে বায়োমেট্রিক যাচাই বাধ্যতামূলক করা হবে, এমনকি পুরনো সিমের ক্ষেত্রেও পুনরায় যাচাইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হচ্ছে, যেখানে নাগরিকরা নিজের এনআইডি ও জন্মতারিখ ব্যবহার করে অনলাইনে সব সিম দেখতে পারবেন।
বাংলাদেশে মোবাইল সিম এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি ডিজিটাল অর্থনীতি, ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং এবং স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
বিটিআরসির এই উদ্যোগ হয়তো অনেকের জন্য কিছুটা ঝামেলার, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল পরিষেবাকে আরও শক্তিশালী করবে।
আজকের পর থেকে আর কোনো এনআইডিতে ১০টির বেশি সিম থাকবে না—এটাই বাংলাদেশের টেলিকম ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
MAH – 13555 I Signalbd.com



