অর্থনীতি

চালের বাজারে অস্থিরতা: সিন্ডিকেটের পাঁয়তারা

Advertisement

বাংলাদেশে আবারও চালের বাজারে অস্থিরতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলেছেন, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের মতে, যখন চালের সরবরাহ বেড়ে বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে, তখনই করপোরেট স্বার্থে কিছু ব্যবসায়ী গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়ানোর ফন্দি আঁটছে।

তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাল আমদানি বন্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং আমদানি অব্যাহত থাকবে—যাতে বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকে এবং সাধারণ মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।

গুজবের পেছনে করপোরেট সিন্ডিকেটের হাত

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্প্রতি ‘চাল আমদানি বন্ধ হচ্ছে’—এই গুজবটি ছড়ানো হচ্ছে একেবারে পরিকল্পিতভাবে। এতে বাজারে আতঙ্ক ছড়ানো এবং দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
রাজধানীর চাঁদপুর রাইস এজেন্সির মালিক বাচ্চু মিয়া বলেন,

“করপোরেট কোম্পানিগুলো চাইছে চালের দাম আবার বাড়ুক। তারা গুজব ছড়িয়ে মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সরবরাহ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি।”

তিনি আরও বলেন, যদি তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারত, তাহলে দাম আরও কমে যেত।

সরকার বলছে: ‘আমদানি স্বাভাবিকভাবেই চলবে’

খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন,

“চাল আমদানি বন্ধের কোনো আলোচনা নেই। বরং উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানি অব্যাহত থাকবে।”

তিনি জানান, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কারণে বাজারে নতুন চাল প্রবেশ করছে, ফলে সিন্ডিকেটের সুযোগ অনেক কমে গেছে। তার মতে, আসন্ন আমন মৌসুমে ফলন ভালো হলে চালের দাম আরও কমবে

আমদানির প্রভাবে দাম কমছে

গত দুই মাসে বিভিন্ন মানের চালের দাম কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা কমেছে। বাজার এখন নিম্নমুখী, এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন—যদি আমদানি অব্যাহত থাকে, তাহলে দাম আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত—

  • বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন চাল,
  • সরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩০ টন চাল।

এ বছর মোট ৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকার ১১ লাখ টন গমও আমদানি করেছে।

কোন দেশ থেকে আসছে চাল

সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সর্বশেষ অনুমোদন অনুযায়ী,

  • মিয়ানমার থেকে ৫০ হাজার টন আতপ চাল
  • দুবাই থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সিদ্ধ চাল
    আমদানি করা হচ্ছে।

এই আমদানি আন্তর্জাতিক দরপত্র ও জিটুজি ভিত্তিতে সম্পন্ন হচ্ছে, যার মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা

চালের দাম ওঠানামার চিত্র

দেশের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সরবরাহ বেড়ে দাম কিছুটা কমেছে।

  • ইরি ও স্বর্ণা জাতীয় মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫২ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৫৫-৬০ টাকা।
  • মাঝারি মানের আটাশ ও পাইজাম জাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, সর্বোচ্চ ৭০ টাকা।
  • নাজিরশাইল জাতীয় সরু চালের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ৭ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে ভালো মানের নাজিরশাইল ৮০ টাকা, নিম্নমানের ৭২–৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী আবু ওসমান বলেন,

“মিল মালিকদের সিন্ডিকেট এখন আর তেমন কার্যকর নয়। আমদানি অব্যাহত থাকলে আমন মৌসুমে দাম আরও কমবে।”

সরকারের অভ্যন্তরীণ ক্রয় ও মজুত পরিস্থিতি

চলতি বছর বোরো মৌসুমে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনেছে ৩৬ টাকা কেজি দরে, মোট পরিমাণ ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪২ টন
এছাড়া সিদ্ধ চাল কেনা হয়েছে ৪৯ টাকা কেজি দরে, মোট ১৪ হাজার টন,
আর আতপ চাল কেনা হয়েছে ৫১ হাজার ৩০৭ টন, কেজিপ্রতি ৪৮ টাকা দরে

বর্তমানে সরকারের খাদ্যভাণ্ডারে

  • চাল মজুত রয়েছে ১৪ লাখ ১ হাজার ৪৪৬ টন,
  • ধান মজুত রয়েছে দুই হাজার ৫৬৬ টন।

এই পরিমাণ মজুত সরকারের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব

সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী,
চালের দাম কিছুটা কমায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপও হ্রাস পেয়েছে
আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ছিল ৪৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে কমে ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি ও সরকারের বাজার মনিটরিং জোরদার হওয়ায় এই স্বস্তি এসেছে।

কনজুমার রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের মন্তব্য

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন,

“আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমছে, আর সরকারও আমদানি করছে—যে কারণে দেশে দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু ঠিক এই সময় করপোরেট সিন্ডিকেট নতুন গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সরকারকে এই অপচেষ্টা দমন করতে কঠোর হতে হবে।”

সরকারি বাজেট ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়,

  • অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল কেনার জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা,
  • আমদানির জন্য বরাদ্দ ৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা।

প্রয়োজনে সরকার এই বরাদ্দ বাড়াতে বা কমাতে পারবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তাদের লক্ষ্য হলো—চাল, গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা।

অর্থনীতিবিদদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে তা শুধু খাদ্য নিরাপত্তায় নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল করিম বলেন,

“বাজারে যদি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়, তাহলে শুধু চাল নয়, অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও প্রভাবিত হয়। সরকারকে নিয়মিত মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং যারা গুজব ছড়ায় বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।”

গ্রাহকদের প্রত্যাশা

নিম্ন আয়ের মানুষদের মতে, চালের দাম কিছুটা কমলেও বাজারে এখনো অস্থিরতা রয়েছে।
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের গৃহিণী রুবিনা আক্তার বলেন,

“গত সপ্তাহে ৬৫ টাকায় যে চাল কিনেছি, আজ সেটা ৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যদি আবার দাম বাড়ে, তাহলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে।”

সিন্ডিকেটবিরোধী অভিযানে জোর দাবি

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারকে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সিন্ডিকেটবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করতে হবে।
তাদের মতে, চাল একটি সংবেদনশীল পণ্য; তাই এ বাজারে সামান্য ওঠানামাও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলে।

চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হলে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অযথা গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ানো বন্ধ করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে বাজার মনিটরিং ও আমদানি প্রক্রিয়া জোরদার করেছে—এতে করে বাজারে স্থিতি আসবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের চালের বাজার যেন কৃত্রিম অস্থিরতার বদলে বাস্তব সরবরাহ ও ন্যায্য মূল্যের ভারসাম্যে ফিরে আসে, সেটাই এখন সময়ের দাবি।

MAH – 13550 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button