ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ভয়াবহ আঘাত হেনেছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’। প্রবল বেগে আছড়ে পড়া এই ঝড়ে অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং দুইজন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত করেছে। ঝড়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত, জলোচ্ছ্বাস ও তীব্র বাতাসে রাজ্যের বহু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
ভারতের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ঝড়ের আঘাতে ইতিমধ্যে ৭৬ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঝড়ের কারণে বাতিল হয়েছে শতাধিক ট্রেন ও ফ্লাইট, আর বহু এলাকায় বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
রাত আড়াইটায় আঘাত হানে মোন্থা
ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার গভীর রাতে, অর্থাৎ ২টা ৩০ মিনিটের দিকে, মোন্থা অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। ঘণ্টায় প্রায় ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যায়, যা মুহূর্তেই বাড়িঘর, দোকানপাট ও গাছপালা উড়িয়ে নিয়ে যায়।
তবে সকালের দিকে ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে শুরু করে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী ৬ ঘণ্টার মধ্যে এর তীব্রতা আরও হ্রাস পাবে, যদিও ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।
রেল ও বিমান চলাচলে অচলাবস্থা
অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়া এবং বিশাখাপত্তনম থেকে ছাড়ার কথা ছিল এমন ১২২টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। আরও বেশ কিছু ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।
অন্যদিকে, বিশাখাপত্তনম, বিজয়ওয়াড়া, রাজামুন্দ্রি এবং তেলঙ্গানার শামশাবাদ বিমানবন্দর থেকে ৩৫টিরও বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ভারি বৃষ্টি ও প্রবল বাতাসের কারণে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে।
ফসল ও কৃষিজমিতে ভয়াবহ ক্ষতি
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, মোন্থার তাণ্ডবে রাজ্যে প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ধান, ভুট্টা, মরিচ, তুলা ও পাটের ক্ষেত প্লাবিত হয়ে কৃষকরা দিশেহারা।
রাজ্যের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ইতোমধ্যে জরুরি সহায়তা ও পুনর্বাসন তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯টি জেলায় লাল সতর্কতা জারি
অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলবর্তী ১৯টি জেলায় জারি করা হয়েছে লাল সতর্কতা (Red Alert)। এর মানে, এসব এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টিপাত ও দমকা ঝোড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া ৩টি জেলায় কমলা সতর্কতা এবং ৪টি জেলায় হলুদ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়েছে, স্থানীয় জনসাধারণকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং অপ্রয়োজনে বাইরে না বের হতে বলা হয়েছে।
রাজ্যের দুর্যোগ প্রতিরোধ বাহিনী (NDRF) ও স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা মিলিতভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। উপকূলের বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করায় অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
ওড়িশা ও তেলঙ্গানাতেও প্রভাব
মোন্থার প্রভাবে শুধু অন্ধ্রপ্রদেশই নয়, পার্শ্ববর্তী ওড়িশা ও তেলঙ্গানাতেও ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ওড়িশা রাজ্য সরকার বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সব স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। উপকূলবর্তী ১৫টি জেলায় জনজীবন বিপর্যস্ত। গাছ উপড়ে পড়ায় রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে।
তেলঙ্গানায়ও কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও বৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে হায়দরাবাদ, নালগোন্ডা ও খাম্মাম অঞ্চলে।
পশ্চিমবঙ্গেও প্রভাব ফেলছে মোন্থা
যদিও মোন্থার সরাসরি আঘাত পশ্চিমবঙ্গে পড়েনি, তবে এর প্রভাবে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, বুধবার থেকে কলকাতা, হাওড়া, মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ও হুগলিতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এজন্য রাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর হলুদ সতর্কতা (Yellow Alert) জারি করেছে।
আবহাওয়াবিদদের সতর্কবার্তা
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (IMD) জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোন্থা মূলত বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে উৎপত্তি লাভ করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে এটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে সাইক্লোনিক স্টর্মে রূপ নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের পানির উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় এখন প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিচ্ছে। তারা সতর্ক করেছেন, ভবিষ্যতে এর প্রভাব আরও বাড়তে পারে।
মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম চলছে
অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো যৌথভাবে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
উপকূলবর্তী এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও কাপড় সরবরাহ করা হচ্ছে। NDRF-এর ৪০টিরও বেশি দল, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট বার্তায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
মোন্থার পর কিউবার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে হারিকেন মেলিসা
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে মোন্থার তাণ্ডবের পরই নতুন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টি পড়েছে কিউবার দিকে ধেয়ে যাওয়া হারিকেন মেলিসার দিকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে এই হারিকেনও তীব্র শক্তি সঞ্চয় করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্ধ্রপ্রদেশবাসীর আতঙ্ক ও আশার গল্প
মোন্থার ভয়াবহতায় হাজারো মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছে। বিশাখাপত্তনম জেলার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন,
“বাতাসের শব্দে পুরো গ্রাম কাঁপছিল। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে রাতে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখন জানি না ঘরে কিছু অবশিষ্ট আছে কি না।”
সরকার বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো মেরামতের জন্য আর্থিক সহায়তা ও খাদ্য সরবরাহ চলবে যতদিন প্রয়োজন।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন বার্তা
মোন্থা কেবল অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই জলবায়ু সংকটের সতর্ক বার্তা। পরিবেশবিদদের মতে, গত এক দশকে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
তাদের মতে, এর মূল কারণ সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, এবং অস্থিতিশীল আবহাওয়ার ধারা। ফলে ঘূর্ণিঝড়গুলো আরও বেশি শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে।
অন্ধ্রপ্রদেশে ঘূর্ণিঝড় মোন্থা হয়তো ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, কিন্তু এর রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন গভীর। হাজারো মানুষ হারিয়েছে ঘরবাড়ি, ফসল নষ্ট হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পুনর্গঠনের আশাও দেখা যাচ্ছে।
মানুষের প্রাণ রক্ষা ও পুনর্বাসনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মোন্থা যেন মনে করিয়ে দিল— প্রকৃতির সামনে মানবজাতি কতটা অসহায়, আর প্রকৃতিকে অবহেলা করলে তার প্রতিশোধ কত ভয়াবহ হতে পারে।
MAH – 13529 I Signalbd.com



