গাজায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া ঘোষণা দিয়েছে— তারা শান্তি ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে গাজায় শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম রবিবার (২৬ অক্টোবর) এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেই এই শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে চায় কুয়ালালামপুর।
মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বার্নামার প্রতিবেদনে জানানো হয়, কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ৪৭তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে আসা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় আনোয়ার ইব্রাহিম এই প্রস্তাব দেন।
“গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক ঐক্য দরকার” — আনোয়ার ইব্রাহিম
বৈঠকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গাজায় যা ঘটছে, তা কেবল একটি দেশের নয়— সমগ্র মানবতার বিবেকের পরীক্ষা। আমরা ফিলিস্তিনের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে পাশে আছি। মালয়েশিয়া শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে প্রস্তুত, যদি জাতিসংঘ বা ওআইসি এই উদ্যোগ গ্রহণ করে।”
আনোয়ার ইব্রাহিম আরও জানান, গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, খাদ্য ও চিকিৎসা অবরোধ, এবং বেসামরিক মানুষের উপর নির্বিচারে হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি বলেন, “আমরা চাই এই বর্বরতা থামুক। নিরীহ নারী-শিশুর আর রক্ত ঝরুক না। মালয়েশিয়া শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে।”
জাতিসংঘ ও আইসিজের সিদ্ধান্তে সমর্থন মালয়েশিয়ার
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার জাতিসংঘের ধারাবাহিক অবস্থানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, গাজায় মানবিক সহায়তা অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটি গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মালয়েশিয়া মনে করে— আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ইসরায়েলি বাহিনীর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটে।
গাজায় বর্তমান পরিস্থিতি: ধ্বংসস্তূপে পরিণত একটি শহর
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ থেকে গাজায় নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। প্রায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত, হাসপাতালগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছে।
গাজা এখন কার্যত একটি “মানবিক বিপর্যয়ের নগরী”। জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা (UNOCHA) জানিয়েছে, গাজায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন শিশু অপুষ্টি ও চিকিৎসা সংকটে মারা যাচ্ছে। মালয়েশিয়া এই অবস্থাকে “অসহনীয় ও অমানবিক” বলে বর্ণনা করেছে।
ওআইসি ও আসিয়ানের ভূমিকা: আঞ্চলিক ঐক্যের আহ্বান
আনোয়ার ইব্রাহিম বৈঠকে বলেন, “গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য এখন অপরিহার্য। ওআইসি, আসিয়ান এবং জাতিসংঘের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই আমরা শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে শান্তি ও সংলাপ প্রতিষ্ঠায় সবসময় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার বিরোধ নিরসন এবং মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংলাপ প্রতিষ্ঠায়ও মালয়েশিয়া ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো কি বাস্তবসম্মত?
বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার এই ঘোষণা কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবে গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের দৃঢ় মিত্র হওয়ায় সেই অনুমোদন পাওয়া সহজ নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. মাহাথির আজমি বলেন, “মালয়েশিয়া তার নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এখন দায়িত্ব জাতিসংঘ ও ওআইসি-র ওপর— তারা কি সত্যিই মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে পারবে, নাকি রাজনৈতিক স্বার্থে নীরব থাকবে।”
মালয়েশিয়ার মানবিক সহায়তা ও ফিলিস্তিন নীতি
মালয়েশিয়া বহু বছর ধরেই ফিলিস্তিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র। দেশটি নিয়মিতভাবে গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাদ্য ও ত্রাণ পাঠিয়ে আসছে। ২০২৪ সালে কুয়ালালামপুরে “ফিলিস্তিন সলিডারিটি ফান্ড” গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া মালয়েশিয়ার অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেমন MERCY Malaysia, Global Peace Mission ইত্যাদি সংস্থা সরাসরি গাজায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম নিজেও বহুবার বলেছেন, “ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি নয়— এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নতুন আশার সঞ্চার
আনোয়ার ইব্রাহিমের শান্তিরক্ষী প্রস্তাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও কাতার ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেছেন, “মালয়েশিয়ার প্রস্তাব একটি সাহসী পদক্ষেপ। এটি গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম বাস্তবিক উদ্যোগ হতে পারে।”
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, “গাজায় শান্তিরক্ষী মিশনের সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এর জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন।”
মানবতার পক্ষের কণ্ঠস্বর হিসেবে মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম মুসলিম বিশ্বে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের অন্যতম প্রবল কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। তিনি বারবার বলেছেন, “ফিলিস্তিনের প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকা মানে অন্যায়ের পাশে দাঁড়ানো।”
তার নেতৃত্বে মালয়েশিয়া কেবল রাজনৈতিক নয়, মানবিক দিক থেকেও ফিলিস্তিনের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সংসদে একাধিকবার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়েরের আহ্বান জানানো হয়।
গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা: আশার আলো না কূটনৈতিক প্রতিরোধ?
বিশ্ব বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় শান্তিরক্ষী মিশন বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। ইসরায়েল ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের কোনো বাহিনীকে গাজায় প্রবেশ করতে দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে মুসলিম দেশগুলো একত্র হলে এটি এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আলী হানাফি বলেন, “মালয়েশিয়ার এই প্রস্তাব কেবল সামরিক বা কূটনৈতিক নয়— এটি একটি নৈতিক ঘোষণা। মানবতার ইতিহাসে এর মূল্য অনেক।”
গাজা এখন বিশ্বের বিবেকের সামনে একটি প্রশ্নচিহ্ন। সেখানে শান্তির আহ্বান মানে কেবল যুদ্ধ থামানো নয়, মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ। মালয়েশিয়া সেই দায়বদ্ধতাকে বাস্তব রূপ দিতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে কুয়ালালামপুর এখন এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যেখানে কথার সঙ্গে কাজের মিল রয়েছে। গাজায় শান্তিরক্ষী পাঠানোর এই উদ্যোগ সফল হোক বা না হোক— এটি নিঃসন্দেহে মানবতার ইতিহাসে এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
MAH – 13523 I Signalbd.com



